অন্যান্য বিভাগ


বিপদ যখন সৌভাগ্যের প্রতীক  

- তামীম রায়হান -

আমাদের সমাজে আশেপাশে এমন অহরহ অনেক লোককে আমরা দেখি- যারা সামান্য বিপদে পড়লে হায় হায় করে কপাল চাপড়ে বলতে থাকে- আল্লাহ কি আমারে ছাড়া আর কাউকে দেখল না!! ছোটখাট দূর্ঘটনায় ঘাবড়ে গিয়ে আবোল তাবোল বলা আমাদের অনেকের নিত্যঅভ্যাস। অথচ কেউ যদি এর প্রকৃত রহস্য ও ফলাফল জানতো- তবে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো।
আমরা সবাই মুসলমান হিসেবে বিশ্বাস করি- ভাগ্যের ভাল মন্দ সবকিছু আল্লাহপাকের নিয়ন্ত্রণে। তিনি যা ইচ্ছে করেন- তা-ই হয়ে থাকে- তার ইশারা ছাড়া কিছুই হতে পারেনা। আর তিনি মানুষের জন্য যখন যা নির্ধারণ করেন- তা অবশ্যই তার জন্য মঙ্গলজনক- যদিও কিছুসময়ের জন্য বাহ্যিকভাবে তা কষ্টকর মনে হয়। মূলত এসব দিয়ে তিনি আমাদের ঈমান ও ধৈর্যকে একটু যাচাই করতে চান। 

রাসূল সা. বলেছেন, বিপদ মুসীবত যত বড়- এর প্রতিদানও তত বড়, আর আল্লাহ পাক যখন কাউকে ভালোবাসেন তখন তাকে পরীক্ষা করেন- এ পরীক্ষায় যে খুশী থাকে তার জন্য আল্লাহ পাকও খুশী হয়ে যান, আর যে রাগান্বিত হয়, তার জন্য তিনিও রেগে যান। (তিরমিযী)
স্পষ্ট বুঝা গেল যে, বিপদাপদ রোগব্যাধি যা কিছুই হোক না কেন, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা- এ পরীক্ষায় টিকতে পারলে পরিণতি শুভ হয়, আর হেরে গেলে পরিণতি মন্দ হয়। এই একটি হাদীসই বিপদস্তদের জন্য সান্তনা ও হতাশ লোকদের হীনম্মন্যতা দূর করার জন্য যথেষ্ট।
সামান্য বিপদের জন্য সামান্য সওয়াব, আর কঠিন ও জটিল সমস্যার জন্য অনেক অনেক সওয়াব ও প্রতিদান। মূলত আল্লাহ পাক এসব দিয়ে তার বান্দার ভেতরের ঈমানকে নেড়ে চেড়ে দেখেন- এর ভিত কতখানি মজবুত। যে আল্লাহ তাকে এত ভালোবেসে এতদিন সুখে রাখলেন, তারই তরফ থেকে সামান্য বিপদ এর পরীক্ষায় সে কি সত্যিই খুশী থাকে নাকি আবোল তাবোল বকে রাগ হয়ে বসে থাকে।
মানুষ হিসেবে সবার ভাগ্যে সুখ-অসুখের মিশ্রণ রয়েছে। কিন্তু মুসলমান হিসেবে আমরা এর যে প্রতিদান আশা করতে পারি- অন্যরা তা থেকে বঞ্চিত। কারণ এ বিপদ মুসীবত শুধু আমাদের গোনাহগুলো মাফ হওয়ার কারণ নয়, বরং এর সাথে সাথে আমাদের মর্যাদাও বৃদ্ধি হয়। পূণ্যের খাতায় যোগ হয় অনেকগুলো নেকী- যা হয়তো সাধারণভাবে আমল করে অর্জন সম্ভব হতো না।
ইবনে মাসঊদ রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. বলেছেন, কোন মুসলমানের যত সামান্য কষ্টই হোক না কেন, চাই তার পায়ে একটু কাঁটাও যদি লাগে এর চেয়েও বেশী কিছু হয়, এর বিনিময়েও আল্লাহ পাক তার গোনাহগুলোকে মাফ করে দেন যেভাবে গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ে। (বুখারী)
আরেক হাদীসে আল্লাহর রাসূল বলেছেন, আল্লাহ পাক যখন কোন বান্দার ভালো চান- তখন তাকে দুনিয়াতে কিছু কষ্ট দিয়ে দেন (যাতে পরকালে সে এসব থেকে মুক্ত থাকে) আর যার জন্য তিনি ভালো চান না- তার থেকে সব বিপদাপদকে সরিয়ে রাখেন- যাতে কিয়ামতের দিন এগুলো দিয়ে তাকে প্রতিদান দেওয়া হয়। (তিরমিযী)
প্রখ্যাত তাবেয়ী ও বুযুর্গ হযরত হাসান বসরী বলতেন, বিপদাপদ ও মুসীবতকে তোমরা অপছন্দ করো না, অনেক বিষয় যা তোমাদের অপছন্দ- তাতেই হয়তো তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে, আর কোন বিষয় হয়তো তোমাদের কাছে ভালো মনে হচ্ছে অথচ এর মধ্যেই অকল্যাণ লুকিয়ে আছে।
আরেক মনিষী ফযল বিন সাহল বলতেন, অনেক বিপদ ও কষ্ট এমন রয়েছে যেগুলো মূলত বুদ্ধিমানদের জন্য উপহার। এসব কষ্টের মাধ্যমে গোনাহ মাফ হয়, ধৈর্য ধরার সওয়াব পাওয়া যায়, উদাসীনতা থেকে সজাগ করে দেয়, সুস্থতা ও শান্তির মূল্য বুঝা যায়, তওবার জন্য সতর্কতা এবং দান সদকার করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়।
আর এজন্যই মুসলমানদের জীবনে ও মরণে কোন কাজেই তার জন্য ক্ষতি নেই। রাসূল সা. বলেছেন. মুমিন ব্যক্তির ভাগ্য কতই না ভাল, তার সবকিছুতেই তার জন্য কল্যাণ। মুমিন ছাড়া এমন ভাগ্য আর কেউ পায়নি। মুমিন ব্যক্তি সুখে থাকলে শোকর আদায় করে- এতে তার জন্য পূণ্য লেখা হয়, আর অসুখে থাকলে সে ধৈর্য ধরে- এতেও তার জন্য পূণ্য লেখা হয়। (মুসলিম)
তাই জীবনে চলার পথে যে কোন পর্যায়ে বিপদ আপদ কিংবা অসহনীয় যে কোন পরিস্থিতিতে পড়ে গেলে হা হুতাশ না করে বরং এ দূরাবস্থায়ও আল্লাহমুখী হয়ে অবনত হওয়া প্রকৃত মুসলমানের কাজ। কারণ ভাগ্যে যতটুকু লেখা আছে তা তো হবেই- কাজেই ধৈর্য ধরলে এখানেও সে পূণ্যের ভাগীদার হল, আল্লাহ পাকও তার উপর খুশী হলেন, আর আবোল তাবোল বললে সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হল, পরিস্থিতি আরও জটিল হল।
পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে ধৈর্যশীলদের জন্য সুসংবাদ ও মহাপ্রতিদানের কথা এসেছে। সূরা বাকারার ১৫৫ নং আয়াত থেকে আল্লাহ পাক বলেছেন, ধৈর্যশীলদেরকে সুসংবাদ দিন, তারাই ধৈর্যশীল- যারা বিপদগ্রস্ত হলে বলে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন (নিশ্চয়ই আমরা তো আল্লাহর জন্য, আর আমরা তো তার কাছেই ফিরে যাবো) এসব লোকদের জন্য তাদের রবের পক্ষ থেকে দুআ ও রহমত- এরাই সরলপথ প্রাপ্ত।
নামাজ রোযার ধার ধারেনা- ধর্মকর্ম থেকে উদাসীন এমন অসংখ্য লোককে আমরা খুব সুখে শান্তিতে বাস করতে দেখি- আমরা হয়তো ভাবি- আহা! ওরা কতইনা ভাগ্যবান, নামাজ না পড়লেও কত সুখে আছে তারা। 
এসব অমূলক ধারণার জবাব দিয়ে হাদীসের কিতাবসমূহে বর্ণিত হয়েছে, মুমিন মুসলমানের উদাহরণ হল ছোট চারাগাছের মতো, চারাগাছ যেমন সবসময় বাতাসে এদিক ওদিক হেলেদুলে থাকে- তেমনি ছোট খাটো কষ্ট আর বিপদ মুমিন ব্যক্তির জীবনে লেগেই থাকে- যাতে সে সবসময় আল্লাহমুখী থাকে এবং অসংখ্য সওয়াবের অধিকারী হতে পারে। আর বেআমল ব্যক্তির উদাহরণ শক্ত গাছের মতো, সামান্য বাতাস তার গায়ে লাগেনা, কিন্তু যেদিন ঘূর্ণিঝড় হবে- সেদিন তার শেকড় থেকে সে উপড়ে পড়বে। 
কাজেই আজ থেকে আর অযথা ভাগ্য কিংবা বিপদাপদ নিয়ে গালমন্দ ও হতাশা নয়, সর্ববস্থায় নিজেকে মহান দয়াময় স্রষ্টার হাতে সঁপে দিয়ে খুশী থাকার মধ্যেই প্রকৃত শান্তি ও সফলতা এবং এটাই পরম সৌভাগ্যবানের আলামত।