চার মাযহাবের
ভিন্নতা কি ধর্মের বিভক্তি?
তামীম রায়হান
হজ্ থেকে
ফেরার পর কোন এক হাজী সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, মক্কায় কেমন দেখলেন? তিনি একটু ভাব নিয়ে
বললেন,
মক্কায় গিয়ে দেখি, খালি আযানটা দেয় বাংলায়, আর বাকী সবই কেমন
যেন মনে হল। বেচারা হাজী সাহেব যে আযান সবসময় নিজের গ্রামে শুনেন, সে আযানই মক্কায় শুনতে পেয়ে ভাবলেন, এটা তো বাংলাদেশের বাংলা আযান। বাকী নামায অন্যান্য ইবাদত তো
অন্যরকম- তাই এ নিয়ে তিনি সন্দিহান।
সাধারণত বাংলাদেশের কোন মসজিদে যদি কেউ হানাফী ছাড়া অন্য মাযহাবের নিয়মে নামায পড়ে তবে সবাই হা করে তাকিয়ে থাকে, কেউ কেউ ভাবে, আহা বেচারা! কী কষ্ট করে ভুল নামায পড়ছে!!
সাধারণত বাংলাদেশের কোন মসজিদে যদি কেউ হানাফী ছাড়া অন্য মাযহাবের নিয়মে নামায পড়ে তবে সবাই হা করে তাকিয়ে থাকে, কেউ কেউ ভাবে, আহা বেচারা! কী কষ্ট করে ভুল নামায পড়ছে!!
আদিকালের
গাঁও গেরামে এ মাযহাব এর নামে কত যে সংঘর্ষ হয়েছে এবং হচ্ছে- তার হিসেব নেই। আমরা বাংলাদেশীরা
প্রায় সবাই হানাফী মাযহাবের মতে আমল করি। কিন্তু তাই বলে কি বাকী তিনটি মাযহাব অন্য
ধর্মের মতো ভিন্নরকম? তাদের ইবাদতও কি
আমাদের মত শুদ্ধ ও কবুল হয়? তাদের সাথে কি বিয়ে
শাদী ও অন্যান্য লেনদেন বৈধ?
আশ্চর্যের
হলেও সত্য যে, অনেকের মনে এসব ভাবনা ঘুরপাক খায়, তারা বাঁকা চোখে অন্য মাযহাবের লোকদের চালচলনের দিকে তাকায়।
কোন সন্দেহ
নেই যে,
জ্ঞানের স্বল্পতা ও মনের সংকীর্ণতা এসবের একমাত্র উৎস ও কারণ।
রাসূল সা. বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে নামায আদায় করেছেন। সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে যখন
যে যেভাবে দেখেছেন, তারা সেভাবেই নামায
পড়তেন। অন্যান্য ইবাদতের বেলায়ও তাই। যে সাহাবী যে পদ্ধতি রাসূলের কাছ থেকে শিখেছেন
ও দেখেছেন, তিনি বাকী জীবন ওভাবেই আমল করেছেন।
এ পার্থক্য শুধু অর্থ অনুধাবনে ও আদায়ের পদ্ধতিতে, অন্য কিছূ নয়।
তার মানে
কিন্তু এই নয় যে, কেউ এক রাকাতে দুই
রুকু কিংবা তিন সিজদা করেছেন। রমযানের রোযা কেউ কম বা বেশী রেখেছেন, যাকাতের হিসেবে চল্লিশ ভাগের একভাগের চেয়ে কেউ কম বা বেশী করেছেন-
এমন কিছুই নেই। যেটুকু পার্থক্য রয়েছে- তা কেবলই আদায় করার পদ্ধতি নিয়ে। কোন সন্দেহ
নেই যে এর সবগুলোই রাসূল আদায় করেছেন, তবে বর্ণনাগত দূরত্ব বা নৈকট্যের তারতম্যে চার মাযহাবের ইমামগণ সেখান থেকে কোন
একটিকে বাছাই করেছেন। কখনো কখনো বহু অর্থবোধক শব্দের আসল অর্থ নির্ধারণের তারতম্যে
ভিন্নতা সুষ্টি হয়েছে। কেউ আভিধানিক অর্থ নিয়েছেন কেউ পরিভাষার অর্থ। তাই কোন এক মাযহাব
সঠিক আর বাকীগুলো ভুল- এমন ধারণা সম্পূর্ণ অবাস্তব।
তাই বলে কি
আমরা সুবিধা মত সব মাযহাবের উপর আমল করা শুরু করব? না,
তা নয়। কারণ এতে দ্বীন ও ইবাদত তখন আমাদের সুবিধামত খেলার উপকরণে
পরিণত হবে। বরং যে যে মাযহাব এর পদ্ধতি শিখেছে, সে সেভাবেই পুরো দ্বীনকে মানতে হবে।
এ কথাও মনে
রাখতে হবে, হানাফী মাযহাবের অনুসারী মানে কিন্তু
ইমাম আবু হানিফার অনুসরণ নয়, আমরা ইমাম আবু হানিফার
মাধ্যমে রাসূল সা. কেই অনুসরণ করছি। ইমাম এখানে নিছক মাধ্যম ছাড়া আর কিছু নয়।
কুরআন ও সুন্নাহর
বিশাল সাগর পাড়ি দেয়া আমাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়, এর পথ ও পদ্ধতি রপ্ত করাও দুঃসাধ্য বিষয়। তাই সাধারণ মুসলমানদের জন্য চার ইমাম
এর চার মাযহাব হল নৌকার মতো। এ নৌকাগুলোর মাধ্যমে মুসলমানরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে দ্বীনের
সাগর পাড়ি দিয়ে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির বন্দরে ভীড়ে।
এখন যদি এ
নৌকাগুলোর যাত্রীরা সাগর পাড়ি দেওয়া বাদ দিয়ে পারস্পরিক ধাক্কাধাক্কি ও ঠুকোঠেুকিতে
লিপ্ত হয় তবে ছিটকে পড়ে হাবুডুবু খাওয়া ছাড়া উপায় নেই, তীরে আর পৌঁছা যাবে না। মাযহাব নিয়ে অশ্রদ্ধা ও পারস্পরিক বিতর্ক
ও সংঘাতের ব্যাপারটি ঠিক এমনই।
কেউ যদি কুরআন
ও হাদীসের এবং ইসলামী শরীয়তের মূল ভিত্তিগুলো সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান ও পান্ডিত্যের অধিকারী
হয় এবং নিজের উপর তার সম্পূর্ণ আস্থা থাকে- তখনই কেবল মাযহাব ছেড়ে দিয়ে নিজের ইজতিহাদ
মতো আমল করা যাবে। বলাবাহুল্য- এমন সুগভীর জ্ঞানের আলেম আজ কল্পনার বিষয়।
আমাদের ভুলে
গেলে চলবেনা যে, আসলে এ চার মাযহাবের মাধ্যমে আল্লাহ
পাকের বিধান ও রাসূলের সুন্নাতের সব পদ্ধতি ও রকমের অনুসরণ হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। এটা কুদরতী
এক নিদর্শন। বিশ্বের সব মুসলমান এক পদ্ধতিতে নামায পড়লে রাসূল এর অন্য পদ্ধতিগুলো হারিয়ে
যেত। পবিত্র কুরআনের সাত ক্বেরাত পদ্ধতির মত এ চার মাযহাবও এ উম্মতের জন্য রহমত। কুরআন
ও সুন্নাহ থেকেই এগুলোর উৎপত্তি।
রাসূল সা.
একবার সফরে রওয়ানা হওয়ার আগে বললেন, সবাই যেন বনু কুরাইযার অঞ্চলে গিয়ে আসর নামায পড়ে। কোন কোন সাহাবী ভাবলেন, রাসূল এ কথা বলার কারণ হল- যেন পথে দেরী না হয়। তাই তারা দেরী
না হওয়ার মতো করে পথেই আসর আদায় করে ফেললেন। আর এক দল ভাবলেন, রাসূল স্পষ্ট করে যা বলেছেন, সেটাই মানা ভাল। তারা সেখানে পৌছে আসর আদায় করলেন। রাসূল সা. এ আগে ও পরে আদায়ের
কথা শুনে দুটোকেই ঠিক বললেন এবং পথে আদায়কারীদেরকে নামায পুনরায় আদায় করতে বলেন নি।
সাহাবাগণ
এ ঘটনায় যেমন রাসূলের উদ্দেশ্য অনুধাবন নিয়ে দু ভাগে ভাগ হয়েছিলেন, চার মাযহাবে ভিন্নতা ঠিক এ রকমই। কিন্তু মৌলিক ও স্পষ্ট বিষয়সমূহে
সবাই সম্পূর্ণ একমত এবং যেটুকু ভিন্নতা রয়েছে- তা নিয়ে তারা কোনদিন বিবাদ কিংবা গালমন্দ
তো দূরের কথা- সামান্য তাচ্ছিল্যও দেখাননি। কারণ কোন এক মাযহাবকে নিয়ে ঠাট্টা করা মানে
স্বয়ং রাসূলের একটি পদ্ধতি বা বর্ণনাকে তুচ্ছ করা।
আর তাই নিজেদের
ইবাদত আদায়ের সময় নিজের মাযহাব সম্পর্কে জানা এবং সঠিকভাবে তা আদায় করাই সচেতন মুসলমানের
কাজ। পদ্ধতির এ ভিন্নতাকে যদি কেউ ধর্মের বিভক্তির মতো গণ্য করে এবং এ নিয়ে তালগোল
পাকায়- তবে ভ্রান্তির উত্তাল সাগরে হাবুডুবু খাওয়া ছাড়া তার কোন সমাধান নেই।
আসুন, ছোটবেলায় নানা দাদারা কে কী বলেছেন, মক্তবের হুজুর কী শিখিয়েছিলেন- সেসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে
যার যার মাযহাব সম্পর্কে আলেমদের কাছ থেকে সঠিক জ্ঞান অর্জন করি এবং আদায় করি। যে কোন
বিশ্বস্ত ও অভিজ্ঞ আলেমের কাছ থেকে জেনে ইসলাম মানার নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহ পাক দিয়ে
রেখেছেন পবিত্র কুরআনে- ‘আর তোমরা
যদি না জানো তবে কোন অভিজ্ঞ কাউকে জিজ্ঞেস করে নাও।’ (নাহল-৪৩)