মুফতি আমিনী রহ. এর স্নেহমাখা সান্নিধ্যে
তামীম রায়হান
মানুষ হিসেবে
প্রত্যেকেই কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এটুকু ক্ষুদ্রতা ও অপারগতা আছে বলেই
তো আমরা মানুষ। আমার অসংখ্য সীমাবদ্ধতা কিংবা ব্যর্থতার একটি হল- খুব প্রিয় মানুষদের
দিয়ে আমি গুছিয়ে কিছুই লিখতে পারি না। এ আমার অক্ষমতা এবং এটি স্বীকারে কোন কার্পণ্য
নেই।
জীবনে যে
কয়জন মানুষের সান্নিধ্যে নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান ভেবে পুলকিত হয়েছি, আমার প্রিয়তম উসতায এবং দিকনির্দেশক হযরত আল্লামা মুফতী আমিনী
রহ,
তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে। আমার তারুণ্যের সূচনায় আমি
তার সাহচর্য পেয়েছি, মানুষ হওয়ার দীক্ষা
নিয়েছি তার হাতেই। খুব কাছ থেকে তার ব্যক্তিত্বের বর্ণিল আলোয় নিজের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নকে
খুঁজে পেয়েছি। এ মহান ব্যক্তিত্বের সাথে আমার স্মৃতিগুলো গুছিয়ে লিখতে গেলে তা বিশাল
কলেবর হয়ে যাবে।
তার সামনে অনেক বড় আকারের একটি টেবিল।টেবিলের উপর ছড়িয়ে আছে কিতাবপত্র।
হাতের কাছে ডানদিকে পানের বাক্স, পানির বোতল এবং তার
ওষুধের ব্যাগ। বামদিকে টেলিফোন। টেবিলের বামপাশে একটি চেয়ার। তিনি বিভোর হয়ে ডুবে আছেন
কিতাবের পাতায়। আমি দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলাম। তিনি মাথা উঁচিয়ে তাকালেন। আমাকে
দেখে এবার সোজা হয়ে বসলেন। তার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়েছে। সালামের জবাব দিলেন মৃদুস্বরে।
তারপর একগাল হাসি হেসে বললেন, ‘কিও!! কখন আসছো?’ এই ছিল তার সাথে আমার দেখা করার নিত্যকার দৃশ্য।
গত দু বছরে
আমি প্রায় আট-নয়বার বাংলাদেশে গিয়েছি। সামান্য এক সপ্তাহের ছুটিতেও ছুটে গিয়েছি দেশে।
আমার মা বাবা বেঁচে আছেন, আমার প্রিয় মুহতারাম
উসতায বেঁচে আছেন- কার সাধ্য আমাকে আটকে রাখে এই কাতারে। রাতভর বিমানে চড়ে সকালে নেমেছি
বিমানবন্দরে, নয়টার মধ্যে বাসায় হাযির। তারপর মায়ের
হাতের নাস্তা খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম। দুপুরেই ছুটে যেতাম হুজুরের কাছে। নতুন নতুন কিতাব
কিনেছি তার জন্য। নিজের হাতে তা তুলে দিব, তার মুখের হাসি তাকিয়ে দেখবো- এই ছিল আমার একান্ত বাসনা। পরম দয়াময়ের কাছে আমি
কৃতজ্ঞ,
তিনি বেশ কয়েকবার সে সুযোগ আমায় দান করেছেন। আমি তার সান্নিধ্যে
বসে দ্বীন দুনিয়ার নানা গল্প শোনার গৌরব পেয়েছি। একটু পেছন থেকেই শুরু করছি।
২০০৭ সাল।
ফরিদাবাদ মাদরাসা থেকে যখন লালবাগে এসে ভর্তি হলাম, আমার ভেতরে অন্যরকম উত্তেজনা ও অনুভব। এই মাদরাসা ঢাকার প্রাচীনতম দুটি মাদরাসার
একটি। কত মনিষী ও আল্লাহওয়ালাদের স্মৃতিধন্য এর পরিবেশ। আমি ভর্তি হলাম মেশকাত জামাতে।
এ জামাতে হুজুরের কাছে কোন ক্লাস নেই। তিনি শুধু বুখারী শরীফ পড়ান। আমার সিট ছিল নীচতলায়
দাওরায়ে হাদীসের পাশের রুমটিতে। হুজুর প্রতি সন্ধ্যায় বুখারী পড়াতে এবং পড়ানোর পর ফিরে
যাওয়ার সময় এ রুমের সামনে দিয়ে হেঁটে যান। তখন থেকেই তাকে প্রতিদিনের দেখা শুরু।
তিনি হাঁটছেন।
মসজিদের আঙিনা পার হয়ে তিনি যাচ্ছেন বুখারী পড়াতে। তার পেছনে ছাত্রদের ভীড়। আবার পড়ানো
শেষে যখন তিনি রুমে যাচ্ছেন, তখনও সেই দৃশ্য।
শাগরেদবেষ্টিত হয়ে তার মনোরম হাঁটাচলার সেই সুবর্ণ দৃশ্য আজো আমার চোখে ভাসছে।
মেশকাতের
বছর আমার সাথে পড়তেন তার ছেলে আবুল হাসানাত ভাই। আর ছিলেন তার বিশ্বস্ত খাদেম ইমরান
ভাই। সে বছর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। স্ট্রোক করলেন। ইবনে সীনায় ভর্তি হলেন। ইমরান ভাইয়ের
সুবাদে আমিও সুযোগ পেলাম তার কাছে থাকার। হাসপাতালে গিয়ে তার মাথার পাশে বসে থাকার
সুযোগ পেলাম। এই প্রথম তার স্পর্শসীমায় চলে এলাম। মানুষটির ব্যক্তিত্ব এবং তার শিশুসুলভ
আচরণ আমাকে মোহগ্রস্ত করে রাখল।
তিনি অসুস্থ
হয়ে বাসায় ফিরে এলেন। দু এক রাত তার বাসায় থাকতে হল। আমরা কয়েকজন। রাতভর তার খাটের
পাশে বসে থাকা। যে মানুষের বজ্র গর্জনে ইসলামী আন্দোলনের প্রাণশক্তি, আমি তার পাশে বসে আছি!! সব ভুলে আমি তাকে খুব কাছ থেকে দেখতে
লাগলাম।
তারপর আমার
দাওরার বছর। তিনি আমার বুখারীর উসতায হলেন। আমি তার সরাসরি ছাত্র হলাম। একেবারে তার
সামনে বসার সুযোগ পেলাম। মাগরিবের পর তিনি পড়াতেন। তার গায়ে একই রঙের পাজামা পাঞ্জাবী
আর কোট। তিনি যখন এসে বসতেন, তার ব্যবহৃত আতরের
খুশবু ছড়িয়ে পড়ত চারপাশে। আমরা পড়তাম বুখারী শরীফ থেকে, তিনি শুনতেন, প্রয়োজনীয় জায়গায় ব্যাখ্যা করতেন। কখনো চশমার উপর দিয়ে কখনো মাথা উঁচু করে তাকিয়ে
থাকতেন। তার চাহনী ও অবয়ব ছিল ভীষণ মুগ্ধকর।
পরম দয়াময়ের
দয়ায় কোন অসুস্থতা কিংবা রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই তিনি সে বছর বুখারী শরীফ শেষ
করলেন। তিনি একাই পড়াতেন পুরা বুখারী শরীফ। টানা কয়েক পৃষ্ঠা করে ইবারত পড়তে হতো আমাদের।
আমিও ছিলাম এ কয়েকজনের একজন। তিনি অবিরাম শুনে যেতেন। কখনো থামিয়ে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে
দিতেন। কখনো কখনো সবক শেষে দুআ করতেন। বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে তিনি হাত উঠাতেন। তারপর
শুরু হত হু হু কান্না। খুব কাছ থেকে আমি তার কান্নার আওয়াজ শুনেছি। তিনি দু পাশে হেলেদুলে
কাঁদতেন,
অঝোর ধারায় তার কান্না। যেন ছোট একটি বাচ্চা বায়না ধরেছে তার
প্রিয়তম সত্ত্বার কাছে।
রাতে সবক
পড়িয়ে তিনি বাসায় ফিরে যেতেন। তার নিরাপত্তা এবং সহযোগিতার জন্য বাসায় যাওয়া আসার সময়
তার সাথে এক-দুই জন ছাত্র থাকতে হতো। সে ধারাবাহিকতায় আমিও সুযোগ পেয়েছি পাশে থেকে
হুজুরকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসার। তিন তলার সিড়ি বেয়ে একেবারে বাসার দরজা পর্যন্ত। তারপর
ফিরে আসা।
ইফতার বছর
তাকে আরও কাছ থেকে দেখেছি। হুজুরের পাশে বসে বিবাড়ীয়া এবং সিলেটসহ নানা জায়গায় গিয়েছি।
ভ্রমণের পুরো সময়টা তিনি নিমগ্ন হয়ে আছেন কিতাবের ভেতর। মাঝেমাঝে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন।
একটু পর পর মুখে পান দিচ্ছেন। সুনসান নিরবতায় গাড়ী ছুটছে দ্রুতগতিতে।
ঈদুল আজহার
জন্য মাত্র ছয়দিনের ছুটি। আমি হুজুরের জন্য কিতাব নিয়ে গেলাম। তিনি আবারও খুশী হলেন।
তার মায়াময় চেহারায় হৃদয়শীতল করা হাসি। হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. এর জীবনী
সংগ্রহ করতে গিয়ে কিছু বিষয়ে স্পষ্ট জানা না থাকায় তাকে সেগুলো জিজ্ঞেস করলাম। তিনি
আমাকে উত্তর দিলেন। আসর থেকে প্রায় মাগরিব পর্যন্ত কথা হল হুজুরের সাথে। আমার চোখের
দূরাবস্থার জন্য তিনি চিন্তিত হলেন। কাছে ডেকে চোখে ফুঁ দিয়ে দিলেন। আহা! এমন মমতায়
আর কে আমায় কাছে ডেকেছে?
গত দুবছরে
যে কয়েকবার বাংলাদেশে গিয়েছি, হুজুরের সাথে দেখা
করা এবং তার সাথে কিছুক্ষণ একান্তে কথা বলা আমার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনও হয়েছে, তিনি তার ভালো লাগা কোন কিতাব নিয়ে কথা বলছেন, ওদিকে তখনও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ছাত্ররা, যারা তাকে নিতে এসেছে বুখারীর সবকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তখনও তিনি
বলছেন,
আমি শুনছি। আরব দুনিয়ার হাল হাকিকত নিয়ে তিনি প্রশ্ন করছেন, আমি উত্তর দিচ্ছি। এত ব্যস্ত এবং গুরুগম্ভীর এই মানুষটির সাথে
আমি সব দ্বিধা ও জড়তা ভেঙে মিশে যেতাম। তিনি হাসতে হাসতে সায় দিতেন কথায়। সে দৃশ্য
মনে হলে আমার কান্না এসে যায়।
হঠাৎ হঠাৎ
তিনি কিছু কথা বলে ফেলতেন, তারপরই সচকিত হয়ে
বলতেন,
এই কথা আবার বাইরে বইলো না। তোমার মধ্যেই রাইখো।’ আমি মাথা নেড়ে সায় দিতাম- জ্বী আচ্ছা। যে কোন কিতাব তাকে দিয়েছি, দু-একদিন পরই আমাকে ডেকে কিতাবটির সম্পর্কে নিজের মতামত জানিয়েছেন।
বিস্ময়ের ব্যাপার, এ দুদিনে তিনি পুরো
কিতাবটি পড়ে ফেলেছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো দাগিয়ে রেখেছেন। কারো লেখা খুব ভালো
লাগলে তিনি জিজ্ঞেস করতেন, তাঁর আর কোন কিতাব
তোমার কাছে আছে? থাকলে আইনো তো।’ সর্বশেষ তিনি আল্লামা বুতীর কিতাব পড়ে দারুণ উজ্জীবিত হয়েছিলেন।
নানাভাবে তিনি লেখকের প্রশংসা করতেন, মাঝে মাঝে আমাকে বসিয়ে সেখান থেকে পড়ে শোনাতেন। নিজের ভালোবাসা ও ভক্তি প্রকাশ
আমাকে দিয়ে শায়খ বুতীর কাছে একটি চিঠিও লিখিয়েছিলেন। শত ব্যস্ততার মধ্যে ইলম ও বিজ্ঞ
আলেমদের জন্য তার আকুলতা ও ভালোবাসা আজকের এ সময়ে তুলনাহীন।
আমি বারবার
তার সরলতা দেখেছি। তিনি যখন অন্তরঙ্গ হতেন, সব ভুলে যেতেন। অন্তত আমার মতো ক্ষুদ্রের সাথে শিশুর মত সরল হয়ে তিনি মিশে যেতেন।
আমার মত এমন ক্ষুদ্রতম ছাত্রের কাছে তিনি জানতে চাইতেন আরব দুনিয়ার হাল হাকিকত। নতুন
কিছু জানলে অবাক হতেন, চেনা মানুষদের কৃতিত্বে
উচ্ছাশ প্রকাশ করতেন। তিনি একটু পরপর নিজের জীবনের ঘটনা শোনাতেন, আকাবিরদের ঘটনা থেকে প্রমাণ দেখাতেন। হুজুরের স্মৃতিশক্তির প্রখরতা
এবং পড়াশোনার গভীরতায় ডুবে যেতাম আমিও। এমনও হয়েছে, কথার তালে হয়তো কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা বাদ পড়ে গেছে, আমি বেরিয়ে আসার একটু পর আবার ফোন করেছেন, তামীম, তুমি কি আশেপাশে
আছো?
থাকলে দেখা করো।’ আমি রিকশা ঘুরিয়ে আবার চলে এসেছি। এমন ভালোবাসায় আর কে আমায়
ডেকেছে?
সুদূর কাতার
থেকে পড়াশোনার নানা বিষয়ে কয়েকবার ফোন করেছিলাম হুজুরকে। তিনি ফোনেই বলে দিতেন, এই বিষয়টা ঐ কিতাবে দেখো, আর আরেকটা কিতাব আছে, ওখানেও দেখতে পারো-
এভাবে লিখো।’ আমি দ্রবীভূত হতাম
এমন পরম স্নেহময় ব্যক্তিত্বের মমতা দেখে। বিস্মিত হতাম তার সুতীক্ষ মেধাশক্তি ও ইলমের
গভীরতা দেখে। আজ আর কে আছে, এমন অভাজনকে এভাবে
আগলে রাখবে? আহা! তিনি আমার উসতায, আমার মুরব্বী- আমি তার সান্নিধ্য পেয়েছি, মানুষ হওয়ার বীজ বুনেছি, এ আমার সামান্য তৃপ্তি, পরম প্রাপ্তি।
১২-১২-১২ এর উন্মাদনায় যখন পৃথিবীজুড়ে হৈ চৈ, ঠিক তখনই আমার ভেতর হিমশীতল হয়ে এল হুজুরের মৃত্যুসংবাদে।
আমার তখন কেমন লেগেছিল- আমি এখনও তা বলে বোঝাতে পারবো না। অজান্তে আমার হাত পা অবশ হয়ে এসেছিল। আত্মার সংযোগ ছিঁড়ে গেল বলেই কি বুকের ভেতর এত প্রবল ঝাঁকুনি অনুভূত হচ্ছিল- আমার জানা নেই। অনবরত একে ওকে ফোন করে আমি কান পেতে শুনেছি লালবাগে সমবেত তার ছাত্র ও ভক্তের কান্নার নিদারুণ সুর, পরদিন ইউনিভার্সিটির কোলাহলমুখর ক্যাম্পাসে এক নিরব জায়গা বেছে নিয়ে তার জানাজার তাকবীর উচ্চারণের করুণ ধ্বনি সরাসরি শুনেছি বন্ধু উসামার মোবাইলের মাধ্যমে, চার হাজার মাইল দূরে থেকে আমার এ বিষন্ন বেলায় আমি অনুভব করেছি তার সরব উপস্থিতি, আমার স্বপ্ন ও হৃদয়রাজ্যে তিনি অমর হয়ে আছেন- তিনি থাকবেন চিরকাল।
তার কাছ থেকে শেখা মানুষ হওয়ার স্বর্ণোজ্জল সবক আমায় পথ দেখাবে যুগ যুগান্তরে।