বিনয় ইসলামের পরিচয়
তামীম
রায়হান
ঘরে
বাইরে সর্বত্র আজ বিনয় ও মানসিক উদারতার যে অভাব তৈরী হচ্ছে, এর আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের
মানবিকতার পূর্ণ বিকাশ। আমরা অনেক কিছু হতে শিখছি, কিন্তু মানুষ হওয়ার দীক্ষা নেইনি আজও।
মদীনার নবী মুহাম্মাদ সা. ছাড়া আর কে পেরেছে নিজেকে বিলিয়ে মানুষকে ভালবাসা
শেখাতে? তিনিই
তো প্রথম বলেছিলেন, আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্বের প্রথম সোপান এ বিনয় ও নম্রতা। আর অহংকার ও
উগ্রতায় তিনি রাগান্বিত হন। আমাদের জীবন তখন হয়ে ওঠে বড়ই অশান্ত ও অস্থির।
ছোটবেলা থেকে গুরুজনদের মুখে বিনয় ও ভদ্রতার উপদেশ শুনতে শুনতে বড় হয়েছি আমরা। রাস্তাঘাটে চলার পথে যানবাহনে লেখা থাকে, ব্যবহারে বংশের পরিচয়। তবুও অশান্ত আজকের পৃথিবী। চারিদিকে মানুষে মানুষে হানাহানিতে পাল্টে যাচ্ছে ব্যবহারের পরিচয়।
ছোটবেলা থেকে গুরুজনদের মুখে বিনয় ও ভদ্রতার উপদেশ শুনতে শুনতে বড় হয়েছি আমরা। রাস্তাঘাটে চলার পথে যানবাহনে লেখা থাকে, ব্যবহারে বংশের পরিচয়। তবুও অশান্ত আজকের পৃথিবী। চারিদিকে মানুষে মানুষে হানাহানিতে পাল্টে যাচ্ছে ব্যবহারের পরিচয়।
প্রযুক্তির বদৌলতে আমরা অনেক কিছুই পেয়েছি। সেই সাথে হারিয়েছিও অমূল্য অনেক কিছু। যান্ত্রিক জীবনে আমাদের মধ্য থেকে দিনদিন বিনয় ও হাসিমুখের সরল সম্ভাণষণ হারিয়ে যাচ্ছে। নিতান্ত পরিচিত কিংবা বন্ধুবান্ধব ছাড়া আমরা কারো সাথে হাসিমুখে কথা বলতে ভুলে গেছি। নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে বিনয় ও সরলতা দিনদিন দুর্লভ হয়ে উঠছে। আত্মঅহমিকা আর অহংকারের সংকীর্ণতায় আবদ্ধ আমরা।
অন্যের কাছ থেকে সত্য মেনে নেয়াকে আজ পরাজয় ধরা হয়। যারা গলা যত উঁচু, সে যেন প্রকৃত বীর। ভুলে বসেছি যে, মুসলমান হিসেবে এসব আমাদের
আচরণ হতে পারে না। স্বার্থবিহীন উদার ও লৌকিকতামুক্ত অকৃত্রিম বিনয় এবং সবার সাথে
মার্জিত ব্যবহার ইসলামের প্রথম শিক্ষা। কারণ এমন গুণাবলী দিয়েই তো আল্লাহপাক
প্রথমে তার পাঠানো নবীদেরকে সুশোভিত করেছেন। তারপর দায়িত্ব দিয়েছেন নবুওয়াতের।
মানুষকে কাছে টানার জন্য নবীদেরকে হতে বলেছেন সরল ও সহজ ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
আল্লাহ পাক বলেছেন, আপনি আপনার অনুসারী মুমিনদের
জন্য নিজেকে কোমল করে রাখুন (সূরা শুয়ারা-২১৫)। আরেক আয়াত, আপনি যদি কঠোর হতেন তবে মানুষ আপনার কাছ থেকে দূরে সরে থাকতো। আপনি তাদেরকে
ক্ষমা করতে থাকুন, তাদের জন্য মাগফিরাত
প্রার্থনা করুন এবং তাদেরকে নিয়ে পরামর্শ করুন (সূরা আলে ইমরান-১৫৯)।’ স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ
পাক তার প্রিয় মানুষটিকে শেখাচ্ছেন, কীভাবে সমাজের সবার সাথে
তিনি মেলামেশা করবেন। সর্বময় গুণের অধিকারী মুহাম্মদ সা.কে শেখানোর মাধ্যমে বরং
তিনি আমাদেরকেও নির্দেশ দিচ্ছেন।
বিনয়ের আসল অর্থ হচ্ছে সত্যকে দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নেয়া- হোক তা যে কারো
কাছ থেকে। এর আরেকটি অর্থ নিজেকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে না করা। প্রখ্যাত
মনিষী হাসান বসরী বলেছেন, নিজের ঘর থেকে বের হওয়ার পর
যে কারো সাথে সাক্ষাত হবে তাকে নিজের চেয়ে ভাল মনে করার নাম বিনয়।
মুসলিম শরীফে ইয়ায রা. বর্ণনা করেছেন, একদিন রাসূল আমাদেরকে বললেন, আল্লাহ পাক আমার কাছে নির্দেশনা পাঠিয়েছেন যাতে তোমরা বিনয়ী হও। একে অন্যের
উপর গর্ব করবে না এবং রাগও হবে না।
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম বলতেন, এ পৃথিবীতে যারা বিনয়ী
থাকবে, কিয়ামতের মাঠে তাদের জন্য কি আনন্দ!! তারা
সেদিন আসনে বসে থাকবে। যারা আজ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলিয়ে তাদেরকে মিলিয়ে
দেয়, তারাই তো সর্বোচ্চ জান্নাত ফিরদাউসের প্রকৃত
অধিকারী।
এ পৃথিবীতে আমরা কি নিয়ে বড়াই করি? সামান্য বিত্ত বৈভবে আমরা
অন্যকে তুচ্ছ করি। আমরা ভুলে থাকি, আমাদের উপর রয়েছেন এক মহান
শক্তিমান স্রষ্টা। তিনি সবকিছু দেখছেন এবং হিসাবের খাতায় এসব লিখে রাখা হচ্ছে।
পরম শক্তিমান আল্লাহ পাকের বড়ত্ব এবং তার শ্রেষ্ঠত্ব যার হৃদয়ে থাকে, সেজন সবসময় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে ভালবাসে। মানুষের সাথে তার আচরণ বিনয় ও
নম্রতায় মিশে থাকে।
মুসনাদে আহমদের এক হাদীসে রাসূল সা. বলেছেন, আল্লাহ পাকের জন্য যে যতবেশি নীচু হবে,(এই
বলে রাসূল নিজের হাতকে মাটির দিকে নামিয়ে দেখালেন) নিজেকে বিনয়ী করে রাখবে, আল্লাহ পাক তাকে ততবেশি উঁচু করবেন (রাসূল তার হাতের তালু উপরের দিকে উঠিয়ে
দেখাল্নে)। অর্থাৎ মানুষের কছে সম্মানিত করবেন।
মুসলিম শরীফের আরেকটি হাদীসে রাসূল সা. বলেছেন, দান সদকায় কখনো সম্পদ কমে না, ক্ষমা ও করুণায় আল্লাহ পাক
ঐ লোকটির সম্মান বাড়িয়ে দেন এবং যে আল্লাহর জন্য বিনয় দেখাল, তাকে তিনি অনেক উঁচুতে অবস্থান করে দেন।
এমন লোকদের প্রশংসা করতে গিয়ে আল্লাহ পাক তাদেরকে নিজের বান্দা বলে পরিচয়
দিয়েছেন। ‘আর পরম দয়াময়র বান্দারা তো নম্র হয়ে হাঁটাচলা করে এবং
কোন মূর্খের সাথে দেখা হলে সালাম দিয়ে চলে যায়।’ (সূরা ফুরকান-৬৩) এখানে ওখানে
বাকবিতন্ডা কিংবা কারো সাথে রেগে যাওয়া তাদের স্বভাব নয়। অন্যত্র তিনি বলেছেন, এই পরকাল তো তাদের জন্য তৈরী করে রেখেছি যারা পৃথিবীতে অনেক বড় সম্মানের
প্রার্থী হতো না। তারা সেখানে হাঙ্গামায় লিপ্ত হতো না। মুত্তাকীনদের জন্যই তো শুভ
পরিণাম। (সূরা কাসাস-৮৩)
ইবনে মাজাহ থেকে বর্ণিত হাদীসে দেখা যাচ্ছে, রাসূল সা. এর সামনে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল এক গ্রাম্য বেদুইন। সে ভাবছিল, কত বড় রাসূল এবং প্রতাপশালী শাসক তিনি। প্রিয়তম নবী তাকে অভয় দিয়ে বললেন, তুমি শান্ত হও। আমি কুরাইশ বংশের এক সাধারণ মহিলার সন্তান, যে মহিলা রোদে শুকানো মাংসের টুকরা খেয়ে দিন কাটাতেন।
বুখারী এবং মুসলিম শরীফের বর্নিত হাদীসে রাসূল সা. আরও বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে জানিয়ে দিব কারা জান্নাতের অধিবাসী? যারা র্দূল এবং তাদেরকে দূর্বল ভাবা হত। অথচ তারা যদি আল্লাহ পাকের নামে কোন
শপথ করে, অবশ্যই তিনি তা পূরণ করে
দেন। তিরমিযী শরিফে বর্ণিত হাদীসে রাসূল সা. সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, মৃত্যুকালে যে মুসলমান অহংকার, উগ্রতা ও বাড়াবাড়ি এবং ঋণ
থেকে মুক্ত- সে জান্নাতে যাবে।
ধরাধমের বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ছিলেন আমাদের নবী। এমন সম্মানিত মানুষ হয়েও কি
অসাধারণ বিনয় ও ঔদার্যের মায়াজালে তিনি পথভোলা মানুষকে কাছে টেনেছেন। কোন মহিলা
এসে ভরা মজলিসে তাকে ডাকলে তিনি উঠে চলে যেতেন। তার প্রয়োজনের কথা শুনতেন। মদীনার
কারো অসুস্থতা কিংবা মৃত্যুর সংবাদে তার বাড়ীতে ছুটে যেতেন। সান্তনা দিতেন। নিজের
হাতে ঘরের কাজকর্ম করতেন। স্ত্রীদের সংসারে সাহায্য করতেন। তার এমন কোমলতা আর
ভালোবাসার বিবরণ এ সামান্য আয়োজনে লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।
আমাদের সমাজে দিনদিন বাড়ছে অস্থিরতা। কারো জন্য আমরা ধৈর্য ধরতে রাজী নই।
মানুষের প্রয়োজনে আমরা চোখ বুঁজে বসে থাকি। যে রাসূলের নামে আমাদের পীর মাশায়েখ
সমাজে এত সম্মানিত, তাদেরই বা কজন রাসূলের এমন
কোমল ও মধুর ব্যক্তিত্বকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পেরেছেন?
ঘরে বাইরে সর্বত্র আজ বিনয় ও মানসিক উদারতার যে অভাব তৈরী হচ্ছে, এর আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মানবিকতার পূর্ণ বিকাশ। আমরা অনেক কিছু হতে
শিখছি, কিন্তু মানুষ হওয়ার দীক্ষা নেইনি আজও। মদীনার
নবী মুহাম্মাদ সা. ছাড়া আর কে পেরেছে নিজেকে বিলিয়ে মানুষকে ভালবাসা শেখাতে? তিনিই তো প্রথম বলেছিলেন, আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্বের
প্রথম সোপান এ বিনয় ও নম্রতা। আর অহংকার ও উগ্রতায় তিনি রাগান্বিত হন। আমাদের
জীবন তখন হয়ে ওঠে বড়ই অশান্ত ও অস্থির।