ওদেরকে আর অবহেলা নয়
তামীম রায়হান
সভ্যতার এ আধুনিক সময়েও আজকাল পত্রিকার পাতায় ঘরের কাজের মানুষের প্রতি
অকথ্য ও অসহনীয় নির্যাতনের খবর দেখা যায়। শহুরে শিক্ষিত হয়েও আমরা সামান্য
অপরাধে কাজের মেয়েটিকে কঠিন শাস্তি দিয়ে স্বস্তি অনুভব করছি- কারণে অকারণে তার
মা-বাবা এবং গোষ্ঠী তুলে গালিগালাজ করছি। আমরা কি ভুলে বসে আছি, একজন শক্তিমান আল্লাহ
সবকিছু দেখছেন এবং শুনছেন, আমাদের প্রতিটি শব্দ ও
কর্মকান্ড সব লিপিবদ্ধ হচ্ছে পাপ-পূণ্যের খাতায়। নিজেকেই না হয় প্রশ্ন করুন, ঘরের অসহায় কাজের মানুষটিকে পড়ালেখা শেখানো তো দূরের কথা, শেষ কবে নিজের ওদের সাথে হাসিমুখে কথা বলেছেন? এ
কি ইসলামের শিক্ষা নয়?
নিজেদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে আমরা একে অপরের সাহায্য ও ভালোবাসা নিয়েই তো বেঁচে আছি। সবল-দূর্বল এবং ধনী-গরীবের এ অপূর্ব সমন্বয়ে টিকে আছে পৃথিবী। জীবনমানের এ ব্যবধানের মধ্যেই লুকিয়ে আছে রহস্য। এমন কম-বেশি আছে বলেই পৃথিবী আজ কর্মময়। স্বয়ং আল্লাহ পাক বিষয়টি জানাচ্ছেন সূরা যুখরুফের ৪৩ নং আয়াতে, ‘আমিই তো পৃথিবীতে তাদের মধ্যে জীবনযাপনের মান ভাগ করে দিয়েছি এবং কাউকে অন্যের উপর সম্মান দিয়েছি।’ তবে তিনি এও বলে দিয়েছেন- এ ব্যবধান আমার কাছে তোমাদের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়, বরং যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খোদাভীরু- সে-ই আল্লাহর কাছে বেশি সম্মানিত।
কারখানার শ্রমিক-কর্মচারী তো বটেই, নিজেদের ঘরের টুকটাক কাজের
প্রয়োজনে আমরা কাজের মানুষ রাখি। কাজের ছেলে কিংবা মেয়ে- ঘরের পরিচ্ছন্নতা থেকে
নিয়ে রান্নাবান্না এবং পরিবেশনের কষ্টকর কাজ তারা করছে দিনের পর দিন। মাস শেষে
বেতনের আশায় তারা মুখ বুঁজে সয়ে যান গৃহকর্তার বকুনী ও অত্যাচার কিংবা সামান্য
ভুলের জন্য অনেক জঘন্য গালিগালাজ অথবা কখনো শারীরিক প্রহার।
আজ চৌদ্দশ বছর পেরিয়ে এসেও শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় মাথা নুয়ে আসে আমাদের
প্রিয়তম রাসূলের উদারতা ও দূরদর্শিতা দেখে। সুদূর মদীনার এ নবী শুধু নামাজ কিংবা
রোজার ইবাদত নয়- ঘরের অসহায় কাজের ছেলে-মেয়েদের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে-
তাও বলে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এ কাজের লোকগুলো তো তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ পাক এদেরকে
তোমাদের আওতায় এনেছেন। তোমরা যে খাবার খাও, তাদেরকেও তেমন খাদ্য দিও। আর
তোমাদের কাপড় চোপড়ের মতো ওদেরকেও পোষাক পরতে দিও। তাদের সাধ্যের বাইরে কোন কাজ
দিওনা। যদি দিয়ে ফেল, তবে তোমরাও তাদের সাথে
সাহায্য করো।’’(মুসলিম-৩১৩৯)
শুধু মৌখিক নির্দেশনা নয়, তিনি তা বাস্তবেও করে
দেখিয়েছেন। এক-দু কিংবা পাঁচ-ছয় বছর নয়, একাধারে দশটি বছর রাসূল সা. এর সেবা করেছেন হযরত আনাস রা.। রাসূলের ঘরে
বাইরের কাজগুলো তিনিই করতেন। তবুও তো ভুল হতো, কখনো তিনি ভুলে যেতেন, ইচ্ছা অনিচ্ছায় ত্র“টি হতো- অথচ রাসূল সা. তাকে কোনদিন আহ কিংবা উফ
শব্দটুকু বলেননি। এমন হয়েছে কেন? অমন করেছো কেন? আর বকা ঝকা কিংবা চড় থাপ্পড় তো দূরের কথা।
রান্নাঘরের চুলার পাশে আগুনের তাপ ও গরম ধোয়া সহ্য করে দিনভর যে মানুষগুলো
রান্না করে চলেছে আমাদের অন্ন আহার- তাদের কথা ভুলে থাকেননি প্রিয়নবী। তাইতো তিনি
বলেছেন, তোমাদের গোলাম-খাদেম (কিংবা কাজের মানুষরা) যখন
খাবার রান্না করে তোমাদের সামনে নিয়ে আসে- অথচ সে এতক্ষণ এর ধোয়া ও উত্তাপ সহ্য
করেছে- তোমরা তাকে ডেকে তোমাদের সাথে বসতে দাও, তাকে খেতে দাও। খাবার যদি
অল্প হয়, যা তাকে পেটভরে দেওয়ার মত
যথেষ্ট নয় তবে অন্তত তার হাতে এক-দু লোকমা উঠিয়ে দাও। (বুখারী)
তিনি ছিলেন মানবতার নবী। ধনী-গরীব এবং সুখী-অসহায় সবার জন্য তিনি ব্যাকুল
ছিলেন সর্বসময়। মৃত্যুশয্যায়ও তিনি ভুলে থাকেননি এ অসহায় গরীব গোলাম-খাদেম
কিংবা চাকর-বাকরদের কথা। তার মৃত্যুর পর যেন তারা অবহেলিত না হয়- সেজন্য তিনি
বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন তাদের অধিকারের কথা। হাদীসের গ্রন্থসমূহে বর্ণিত
ঘটনাসমূহ থেকে জানা যায়, রাসূল সা. এর মুখে সর্বশেষ
উচ্চারিত শব্দগুলোর মধ্যে তিনি বারবার শুধু নামাজ এবং চাকর ও দাসদাসীদের কথা বলে
গেছেন। নামাযের মাধ্যমে তিনি আল্লাহ পাকের সব ইবাদত ও হক আদায়ের ইঙ্গিত করেছেন, তেমনিভাবে চাকর ও দাসদের কথা বলে মানুষে মানুষের পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্য
পূরণের প্রতি জোর দিয়ে গেলেন।
একদিন রাসূল সা. দেখলেন, তারই এক সাহবী আবু মাসউদ এক
চাকরকে মারধর করছেন। তখন তিনি তাকে ডেকে বললেন, শোনো হে আবু মাসউদ! মনে রেখো, তুমি এ গোলামটির সাথে যে অধিকার দেখাচ্ছো, মহান আল্লাহ এর চেয়েও বেশি
তোমার ব্যাপারে শক্তিশালী ও অধিকারী।’ এমন কথা শুনে অনুতপ্ত সাহাবী
তখনই তাকে মুক্ত করে দিলেন। রাসূল সা. তাকে বললেন, এটি যদি তুমি না করতে তবে অবশ্যই তোমাকে আগুনে জ্বলতে হতো।’ (মুসলিম, আবু দাঊদ, তিরমিযী)
একটু কি লক্ষ্য করবেন, নিজের কেনা গোলামের গায়ে
হাত তোলার কারণে রাসূল সা. এ সাহাবীকে কেমন সতর্ক করলেন। কেনা গোলামের ব্যাপারে
যদি এই হয়, তবে আজকাল যারা ঘরে কাজের
মানুষ- তাদের বিষয়টি কত ভয়ংকর। সে তো আর আপনার কেনা গোলাম নয়। সে একজন পূর্ণ
স্বাধীন মানুষ- তারও রয়েছে পূর্ণ সম্মান ও অধিকার- ইসলাম ছাড়া এসব আর কে
শিখিয়েছে?
একলোক এসে রাসূল সা. কে জিজ্ঞেস করছিল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আমার
গোলাম বা খাদেমকে কয়বার মাফ করবো? রাসূল সা. চুপ থাকলেন। লোকটি
তৃতীয়বার প্রশ্ন করলে উত্তরে রাসূল সা. বললেন, প্রতিদিন ৭০ বার। (তিরমিযী)
রাসূল সা. প্রায়ই তার ঘরে কিংবা বাইরে খাদেমকে দেখলে জিজ্ঞেস করতেন, তোমার কি কিছু লাগবে? একদিন তার এমনই প্রশ্নের
উত্তরে এক খাদেম বলে ফেলল, জ্বী ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার
লাগবে। রাসূল সা. বললেন, বলো, তোমার প্রয়োজন খুলে বলো। খাদেম বলতে লাগল, আমার একটিই দাবী, আপনি আমার জন্য কিয়ামতের মাঠে সুপারিশ করবেন। রবীআ নামের আরেক খাদেমের কাছে
গিয়ে তিনি খোঁজ নিতেন, তুমি বিয়েশাদী করছো না কেন?’ তেমনিভাবে এক ইহুদী ছেলে তার কিছু কাজ করে দিত। রাসূল সা. তার অসুস্থতার সংবাদে
স্বয়ং ঐ ইহুদী ছেলেটির বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। নিজের খাদেমদেরকে কাছে
ডেকে তাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও আমলের খবর নিয়েছেন। রাসূল সা. এও বলেছেন, তোমার গোলামের উপর যেটুকু কাজ তুমি হালকা করে দিলে, তা অবশ্যই তোমার নেকীর পাল্লায় যোগ হবে। (ইবনে হিব্বান)
একটি বিষয়ে এখানে দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। কারণে-অকারণে
কিংবা নিজের ছেলে-মেয়ে হোক অথবা চাকর-বাকর, কারো চেহারায় মারা যাবে না।
শিক্ষা দেয়া কিংবা শাস্তিমূলক- যে কারণেই হোক- মুসলিম শরীফের ২৬১২ নং সহ অন্যন্য
হাদীসেও রাসূল সা. স্পষ্টভাষায় নিষেধ করেছেন, কেউ যেন অন্যের চেহারায়
কখনো আঘাত না করে।’ চেহারা একজন মানুষের সবচেয়ে সম্মানিত অঙ্গ, এটিই তার পরিচয়- তাই কখনো কোন মানুষের চেহারায় হাত তোলা নয়। চাই সে নিজের
সন্তান কিংবা ঘরের কাজের মানুষ হোক না কেন, ছোট কিংবা বড়। চেহারার
প্রতিটি অঙ্গ স্পর্শকাতর- চোখ, নাক, কান এবং মুখ- এসবের যে কোন অসম্মান কিংবা অসাবধানতাবশত ক্ষতি যেন না হয়- এটিও
এ হাদীসে বর্ণিত নিষেধের একটি কারণ বলে ইমাম নববী মত দিয়েছেন।
শ্রমিকের বেতন ঠিক সময়ে পূর্ণভাবে আদায় করা নিয়ে অসংখ্য তাগিদ ও এর
অনাদায়ে ধমক বর্ণিত হয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থে। যে তার শ্রমিকের পাওনা আদায়ে
গড়িমসি করছে স্বয়ং আল্লাহ পাক তার প্রতিপক্ষ। রাসূল সা. শ্রমিকের ঘাম শুকিয়ে
যাওয়ার আগেই তার বেতন শোধ করতে বলেছেন। মোহ কিংবা অবহেলায় যেন এসব পাপে আমরা
জড়িয়ে না পড়ি, বরং একজন সচেতন মুমিন হিসেবে
সবার অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হবো- এটাই তো আমার ঈমানের পরিচয়।
সভ্যতার এ আধুনিক সময়েও আজকাল পত্রিকার পাতায় ঘরের কাজের মানুষের প্রতি
অকথ্য ও অসহনীয় নির্যাতনের খবর দেখা যায়। শহুরে শিক্ষিত হয়েও আমরা সামান্য
অপরাধে কাজের মেয়েটিকে কঠিন শাস্তি দিয়ে স্বস্তি অনুভব করছি- কারণে অকারণে তার
মা-বাবা এবং গোষ্ঠী তুলে গালিগালাজ করছি। আমরা কি ভুলে বসে আছি, একজন শক্তিমান আল্লাহ সবকিছু দেখছেন এবং শুনছেন, আমাদের প্রতিটি শব্দ ও কর্মকান্ড সব লিপিবদ্ধ হচ্ছে পাপ-পূণ্যের খাতায়।
নিজেকেই না হয় প্রশ্ন করুন, ঘরের অসহায় কাজের মানুষটিকে
পড়ালেখা শেখানো তো দূরের কথা, শেষ কবে নিজের ওদের সাথে
হাসিমুখে কথা বলেছেন? এ কি ইসলামের শিক্ষা নয়?