পোষাক সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা
তামীম রায়হান
মানুষ যখন বনে জঙ্গলে বাস করতো, তখন তাদের কোন পরিধেয় বস্ত্র থাকতো না। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে মানুষ নিজেকে ঢেকে রেখে মর্জিত হতে শিখেছিল। লজ্জা ও শালীনতার সেখান থেকেই শুরু। এর পূর্ণতা দিয়েছে ইসলাম। আধুনিকতা কিংবা প্রগতির নামে যারা আজ আবার পোষাককে সংকীর্ণ করে মুক্ত সংস্কৃতির দিকে ডাকছে, মূলত তারাই আবার ফিরে যাচ্ছে প্রাকসভ্যতার অন্ধকারের দিকে- যেখানে আদিম মানুষদের বসবাস ছিল একেবারে পশুর মতো বস্ত্রহীন।
একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের পোষাক কেমন হওয়া উচিত- আমরা কী পরব? গোল জুব্বা নাকি কোট টাই প্যান্ট- এ বিতর্ক অনেক দিনের। আমাদের দেশে আজকাল প্রত্যেক তরিকাপন্থীদের পোষাক ও লেবাস আলাদা। সাধারণ মুসলমানদের মধ্যেও এ নিয়ে রয়েছে নানা দ্বিধা দ্বন্দ। কিন্তু মূলত ইসলামে পোষাক সর্ম্পকে কি নির্দেশনা দিয়েছে?
একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের পোষাক কেমন হওয়া উচিত- আমরা কী পরব? গোল জুব্বা নাকি কোট টাই প্যান্ট- এ বিতর্ক অনেক দিনের। আমাদের দেশে আজকাল প্রত্যেক তরিকাপন্থীদের পোষাক ও লেবাস আলাদা। সাধারণ মুসলমানদের মধ্যেও এ নিয়ে রয়েছে নানা দ্বিধা দ্বন্দ। কিন্তু মূলত ইসলামে পোষাক সর্ম্পকে কি নির্দেশনা দিয়েছে?
একটি কথা প্রথমেই বুঝে নেয়া দরকার। ইসলাম কোন নির্দিষ্ট পোষাককে কারো উপর চাপিয়ে
দেয়নি। বরং পুরুষ ও মহিলাদের জন্য শালীনতা ও সৌন্দর্যের সমন্বয়ে কিছু নির্দেশনা ও বিধিমালা
দিয়েছে- এগুলোর আলোকে যে কেউ তার পোষাক বেছে নিতে পারেন। তবে অবশ্যই তাতে যেন পর্দা
ও পোষাকের পূর্ণ অর্থের বাস্তব প্রতিফলন ঘটে।
এ হচ্ছে সাধারণ মুসলমানদের জন্য। কিন্তু প্রকৃত অর্থেই যারা রাসূলকে ভালোবেসে চলতে
চান,
তাদের জন্য তো পবিত্র কুরআন ডেকে বলছে, তোমাদের জন্য রাসূলের জীবনে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। অন্য আয়াতে
আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘আপনি বলুন (হে মুহাম্মদ!) তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো তবে আমাকে অনুসরণ করো। এতে
আল্লাহ পাক তোমাদেরকেও ভালোবাসেন এবং তোমাদেরকে মাফ করে দিবেন।’ আর তাই কোনটি ফরয কোনটি সুন্নত এসব তর্ক-বিতর্কে না জড়িয়ে আসুন আমরা রাসূলের পোষাক
সর্ম্পকিত বর্ণনাসমূহ এবং কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিধিমালাগুলো দেখে নিই।
রাসূল সা. কখনো চাদর গায়ে দিতেন এবং লুঙ্গি পরতেন। তার চাদর প্রায় ছয় হাত লম্বা
থাকতো। তার ব্যবহৃত পোষাকের মধ্যে আরও ছিল, জামা,
জুব্বা, পাগড়ী। তিনি যে কামীস
পড়তেন এর বর্ণনা হচ্ছে- হাতের দিকে কব্জি পর্যন্ত আর লম্বায় টাখনুর উপর পর্যন্ত। তিনি
হাঁটুর নীচে আধাআধি পর্যন্ত পোষাক পরার অনুমতিও দিয়েছেন। তবে সর্বোচ্চ সীমায় টাখনু
পর্যন্ত লম্বা হলেও তা যেন টাখনুর নীচে না ঝুলে, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করেছেন। তিনি কখনো পাগড়ী মাথায় দিতেন এবং পাগড়ীর নীচে
টুপি পরতেন। তিনি টুপি ছাড়া পাগড়ী এবং পাগড়ি ছাড়া শুধু টুপিও পরতেন। রাসূলের পোষাক
ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে শামায়েলে তিরমিযী দেখতে পারেন।
পুরুষদের ক্ষেত্রে ইসলাম যেসব নির্দেশনা দিয়েছে- এগুলোর অন্যতম হল- স্বর্ণ কিংবা
রেশমসম্বলিত কোন পোষাক পরা যাবে না। সতর আবৃত হয় না, এমন যে কোন পোষাক বর্জনীয়। এমন কোন পোষাক গায়ে দেওয়া নিষেধ যা শুধুমাত্র কাফের
ও বিধর্মীদের জন্য নির্ধারিত কিংবা তাদের কোন বিশেষ পোষাক হিসেবে পরিচিত। নারীদের পোষাকের
সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে, এমন পোষাকও ব্যবহার
করতে নিষেধ করা হয়েছে। রাসূল সা. ঐসব পুরুষদেরকে অভিশম্পাত করেছেন যারা নারীদের বেশ
ধারণ করে। (বুখারী-৫৫৪৬)
কাপড় পরার সময় বিসমিল্লাহ বলে ডান দিকের অংশ আগে গায়ে পরিধান করবে। আর খোলার সময়
বাম দিকের অংশ আগে খুলবে। যখনই কোন নতুন পোষাক পরবে তখন আল্লাহ পাকের কৃতজ্ঞতা আদায়
করবে। নিজের পরিধেয় কাপড়গুলো পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখতে ইসলাম উৎসাহ দিয়েছে। সর্বাবস্থায়
নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত অংশ অবশ্যই ঢেকে রাখতে হবে। সাদা রঙের পোষাক পরা মুস্তাহাব।
রাসূল সা. বলেছেন, তোমরা সাদা রঙের
পোষাক পরিধান করো। কারণ তোমাদের অন্যান্য কাপড় ও বস্ত্র থেকে এটি উত্তম। এ সাদা কাপড়েই
তোমাদের মৃতদেরকে কাফন দিও। (তিরমিযী) কেউ কেউ সবুজ রঙের পোষাক পরাকেও মুস্তাহাব বলেছেন।
কারণ পবিত্র কুরআনে জান্নাতী লোকদের পোষাকের বর্ণনায় এ রঙের কথা আল্লাহ পাক উল্লেখ
করেছেন। (ইনসান-২১) হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলের প্রিয় রং হিসেবে সবুজ
এর কথা এসেছে। তবে গাঢ় লাল রং এবং হলুদ রঙের পোষাক পরতে তিনি নিষেধ করেছেন। মুসলিম
শরীফের এক হাদীসে তিনি কোন এক সাহাবীর গায়ে এ রঙের কাপড় দেখে বলেছিলেন, এটি কাফেরদের পোষাক। তোমরা এ রং পরবে না। রাসূল সা. লিনেন, কটন এবং পশম থেকে উৎপন্ন- সব ধরণের পোষাক পরেছেন।
গায়ের যে কোন পোষাক টাখনুর নীচে ঝুলিয়ে পরা হারাম। রাসূল সা. ঐ অংশকে জাহান্নামের
বলে অভিহিত করেছেন। (বুখারী-৫৪৫০) মুসলিম শরীফের এক হাদীসে এমন লোকদের ব্যাপারে বলা
হয়েছে,
‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ পাক তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে ফিরেও তাকাবেন না। বরং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন যন্ত্রণা।’
মানুষকে দেখানোর জন্য এবং নিজের বড়ত্ব ও ভাব দেখিয়ে ‘বাহ বাহ’ পাওয়ার জন্য যে কোন পোষাক পরিধান করা হারাম। আবু দাঊদ শরীফে
ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে, যে কেউ দুনিয়াতে বাহাদুরির পোষাক গায়ে দিবে আল্লাহ পাক তাকে কিয়ামতের দিন অপমানের
পোষাক পরাবেন।
এমনিভাবে নারীদের জন্য ইসলাম কিছু নির্দেশনা দিয়েছে এবং জীবনে চলার পথে সেগুলো
মেনে চলতে তাগিদ দিয়েছে।
নারীর পোষাক অবশ্যই তার পুরো শরীরকে ঢেকে রাখার জন্য যথেষ্ট হতে হবে। হাত এবং চেহারা
নিয়ে কোনো কোনো বর্ণনায় কিছু দ্বিমত থাকলেও বর্তমানের ফেতনা ও নারীর সম্মান ও সম্ভ্রম
রক্ষার তাগিদে মুখ ঢেকে পর্দা করার ব্যাপারে ফকীহগণ একমত হয়েছেন। সূরা নূরে আল্লাহ
পাক আদেশ দিয়েছেন, ‘মহিলারা যেন তাদের গায়ে ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখে।’ সূরা আহযাবে আল্লাহ পাক রাসূলকে বলছেন, ‘আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে ও আপনার কন্যাদেরকে এবং মুমিনদের নারীদেরকে
বলে দিন,
তারা যেন তাদের সারা গায়ে জিলবাব (লম্বা বোরকা) জড়িয়ে চলাফেরা
করে।’ সুতরাং গায়রে মাহরাম পুরুষদের সামনে কিংবা বাইরে বের হওয়ার সময় নিজের পুরো শরীর
ঢেকে রাখতে হবে। আর ঘরের লোকদের সামনে চেহারা, হাত ও পা খুলে চলাফেরা করতে অসুবিধে নেই।
নারীদের ক্ষেত্রে এমন কোন রঙীন পোষাক পরে বাইরে বের হওয়া নিষেধ যা অন্যের দৃষ্টি
আকর্ষন করে। নারীর পোষাক যেন এত ক্ষীণ ও পাতলা কিংবা লাগোয়া না হয় যা তার দেহ আবরণের
জন্য যথেষ্ট নয়। ঢিলেঢালা এবং শালীন পোষাকেই নারীর প্রকৃত সৌন্দর্য ও সুরক্ষা। পুরুষদের
আকর্ষণ করার জন্য সুগন্ধি মেখে ঘরের বাইরে বের হতে রাসূল সা. নিষেধ করেছেন। তিনি এমন
পোষাক পরতেও মানা করেছেন যা পুরুষদের পোষাকের সাথে মিলে যায়। বিধর্মী নারীদের সাথে
সামঞ্জস্য রেখে কোন পোষাক পরিধান করা এবং গর্ব ও অহংকারের জন্য দামী পোষাক পড়ে মানুষকে
দেখানো থেকেও ইসলাম নারীকে তাগিদ দিয়েছে।
এ বিষয়টিও মনে রাখতে হবে, রাসূল সা. স্পষ্টভাবে
বলেছেন,
সুন্দর সুন্দর জামা পরিধান করা কিংবা পোষাকে পরিপাটি হয়ে থাকা
অহংকার নয়। বরং আল্লাহ পাক সুন্দর এবং তিনি বান্দার সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন। এগুলো অহংকার
হিসেবে তখনই গণ্য হবে যখন কেউ সুন্দর জামা গায়ে দিয়ে অন্যকে তুচ্ছ করে এবং নিজেকে সবার
চেয়ে দামী ও সুন্দর ভাবতে থাকে।
খুব সংক্ষেপে ইসলামের পোষাক সম্পর্কিত নির্দেশনা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন। আরবদের
পোষাক কিংবা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির পোষাক দেখে অন্ধ অনুসরণ নয়, পবিত্র কুরআন ও হাদীসে নববীতে যেভাবে মুসলমান পুরুষ ও মহিলাদের
জন্য আবরণের কথা বলা হয়েছে, সেভাবে মেনে চলার
মধ্যে প্রকৃত শান্তি ও সম্মান এবং নিরাপত্তা নিহিত। ভুলে গেলে চলবে না, নিজেদের যুক্তি ও প্রবৃত্তির লালসাকে আল্লাহর জন্য ত্যাগ করে
তার বিধান ও হুকুমের সামনে অবনত হওয়ার নাম ইসলাম। পাশ্চাত্য সভ্যতা আজ নানা অজুহাতে
মুসলমানদের এ পোষাক সৌন্দর্য কেড়ে নিতে চাইছে, নানা প্রলোভনে সুকৌশলে তারা এ আদর্শ কেড়ে নিতে চাইছে। এসব ধোঁকা থেকে সজাগ থাকা
আজ ঈমানের দাবী।
মানুষ যখন বনে জঙ্গলে বাস করতো, তখন তাদের কোন পরিধেয় বস্ত্র থাকতো না। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে মানুষ নিজেকে ঢেকে
রেখে মর্জিত হতে শিখেছিল। লজ্জা ও শালীনতার সেখান থেকেই শুরু। এর পূর্ণতা দিয়েছে ইসলাম।
আধুনিকতা কিংবা প্রগতির নামে যারা আজ আবার পোষাককে সংকীর্ণ করে মুক্ত সংস্কৃতির দিকে
ডাকছে,
মূলত তারাই আবার ফিরে যাচ্ছে প্রাকসভ্যতার অন্ধকারের দিকে- যেখানে
আদিম মানুষদের বসবাস ছিল একেবারে পশুর মতো বস্ত্রহীন।