অন্যান্য বিভাগ

প্রবন্ধ-নিবন্ধ

সামাজিকতার আড়ালে সর্বগ্রাসী অন্যায়

তামীম রায়হান


আমাদের এ অতিশিক্ষিত এবং আধুনিক সমাজের কুৎসিত ও ভয়াবহ ব্যধিগুলোর অন্যতম একটি হল নারীকে অবলা ভেবে তার অংশ ও অধিকারের বিষয়টি অবহেলায় ভুলে যাওয়া। এ সমাজে এমন পরহেজগার নিয়মিত দানখয়রাতকারী নামাজি রয়েছেনযারা আজো তাদের বোনদেরকে বাবার সম্পত্তির ভাগ বুঝিয়ে দেননিনিজের স্ত্রীদের মোহরটুকুও আদায় করেননি।
আমাদের অতি আদরের ও ভালোবাসার একটি ক্ষেত্র মামার বাড়ি। মামাদের কাছে আমাদের আবদারের যেমন কমতি নেইমামাদের পক্ষ থেকে ভাগ্নেদের জন্য স্নেহ ও ভালোবাসারও শেষ নেই। এমন সুপ্রিয় ও মমতাময় মামাদের একটি কুৎসিত চিত্র আমাদের সমাজের নানা মেকি ও কৃত্রিমতায় ঢাকা পড়ে আছে যুগ যুগ ধরে। সেটি হচ্ছে তারা নিজেদের পরম আদরের বোনদেরকে অবলীলায় বাবার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে রাখেন বছরের পর বছর।
কেবল মামারাই নয়আমাদের বাবা চাচারাও অনেকে এ অপরাধে অপরাধী হয়ে আছেন। সমাজের অনেক ওয়ায়েজ ও খতীবও বিস্ময়করভাবে এ বিষয়ে একেবারেই নীরবতা পালন করে চলেছেন। এ বঞ্চিতকরণে মামা-চাচাদের যুক্তিতর্কের কমতি নেই। বোনকে বিয়ে দিয়েছি, আদর যতœ করে আমরাই তো মানুষ করেছি, আপদে বিপদে আমরাই তো এগিয়ে আসছি- এমন নানাবিধ সামাজিকতার দোহাই দিয়ে তারা বোঝাতে চান, বোনরা বঞ্চিত নন।

আমাদের মায়েরাও মুখ বুঁজে এ দুঃখ ও অপমান সয়ে যান জীবনভর, সম্পত্তির কাড়াকড়ি করতে গিয়ে ভাইদের সাথে সুসম্পর্কের অবনতি তাদের কোমল মনে কাম্য নয়। এতকিছুর পরও এসব বিষয়ে তারা স্বামী কিংবা স্বজনদের কটুকথা নীরবে সয়ে যান, ভাইদের নানা উৎসব আনন্দে নিজেদেরই অংশের অপচয় দেখে তারা মুখের কৃত্রিম হাসিতে সেসব ভুলে থাকেন আমৃত্যু। সন্তান ও স্বামীর চোখের আড়ালে তারা এ বঞ্চনা ও অপমানের আঘাতে কাঁদেন লুকিয়ে লুকিয়ে।

প্রিয় পাঠক, পরম স্রষ্টার অপূর্ব হাতে গড়া মায়েরা ভুলে থাকলেও শক্তিমান আল্লাহ পাকের কাছে তা যে এক বিন্দুও ছাড় পাওয়ার মতো নয়, আমরা কি খুব সহজেই তা ভুলে বসে আছি?

মিরাছ বা উত্তরাধিকারের সম্পত্তির বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের কোনটি কয় রাকাত পড়তে হয় তা কুরআনের কোন আয়াতে স্পষ্ট করে সংখ্যা উল্লেখ না করলেও মহান প্রজ্ঞাময় আল্লাহ পাক সম্পত্তি ভাগের বিষয়টি প্রত্যেকের ভাগ উল্লেখ করে তাদের অংশীদারিত্বের নির্দিষ্ট পরিমাণটুকুও উল্লেখ করে জানিয়ে দিয়েছেন। সব ফক্বীহ, মুহাদ্দিস এবং মুফাসসিরগণ এ বিষয়ে একমত যে, মিরাছের বিষয়ে সামান্যতম নিজস্ব ইজতিহাদ কিংবা গবেষণার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। এ বিষয়ে কোনো ছাড় নেই, নেই কোনরূপ টালবাহানার কিংবা হিলা কৌশলের ফাঁকফোকর।

আমাদের এ অতিশিক্ষিত এবং আধুনিক সমাজের কুৎসিত ও ভয়াবহ ব্যধিগুলোর অন্যতম একটি হল নারীকে অবলা ভেবে তার অংশ ও অধিকারের বিষয়টি অবহেলায় ভুলে যাওয়া। এ সমাজে এমন পরহেজগার নিয়মিত দানখয়রাতকারী নামাজি রয়েছেন, যারা আজো তাদের বোনদেরকে বাবার সম্পত্তির ভাগ বুঝিয়ে দেননি, নিজের স্ত্রীদের মোহরটুকুও আদায় করেননি।
এরা হয়তো ভুলে বসে আছেন, কিয়ামতের মাঠে সামান্য এক ইঞ্চি সম্পত্তি গ্রাসের কারণে কত মানুষের সারাজীবনের সঞ্চিত পূণ্যগুলো নিমিষে তুলার মতো হাওয়া হয়ে যাবে। সেসব চলে যাবে বঞ্চিতের ভাগে, জাহান্নামের অতল গর্ত ছাড়া তার আর কোনো গতি নেই সেদিন। আরও ভয়াবহ বিষয় হলো, স্বয়ং আল্লাহ পাকেরও ক্ষমতা নেই কোন প্রতারিত কিংবা বঞ্চিত মানুষের হক মাফ করে দেওয়ার।
পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে, মহিলাদেরও অংশ রয়েছে তাদের মা বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে (সূরা নিসা-৭) অন্যত্র রয়েছে, আল্লাহ পাক তোমাদেরকে ওসিয়ত করছেন তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে (সূরা নিসা-১১)। বাবার সম্পত্তি থেকে নারী ও পুরুষের অংশীদারিত্বের পরিমাণে তারতম্য থাকলেও গুরুত্ব এবং আবশ্যকতায় কোন পার্থক্য নেই। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার অবকাশ এখানে নেই।
যেদিন থেকে ছেলেদের সম্পত্তি বন্টিত হবে ঠিক সেদিনের ঐ ক্ষণেই মেয়েদের অংশও বুঝিয়ে দিতে হবে। যদি তা না করা হয়, তবে তখন থেকেই সব ভাই ও স্বজনরা বোনদের সম্পদগ্রাসী খেয়ানতকারী হিসেবে আল্লাহর কাছে তালিকাবদ্ধ হয়ে যাবে, সামাজিকতার এসব বিচিত্র টালবাহানার কোন গ্রহণযোগ্যতা ঐ তালিকা থেকে আপনার নামটুকু মুছে দিতে পারবেনা। আজকের এ সামান্য সম্পত্তির লোভ আপনার পরকালে সর্বগ্রাসী পাপ হয়ে কেড়ে নিবে জীবনের সব সঞ্চিত পূণ্য ও নেক আমল। মানুষের হক নিয়ে যেসব সতর্কবানী ও ভয়াবহ শাস্তির বিবরণ এসেছে রাসূলের পবিত্র হাদীসের কিতাবসমূহে- সেসব পড়লে গা শিউরে ওঠে যে কোন পাষাণের।
প্রিয়তম শেষনবী আইয়ামে জাহিলিয়াতের সেই বর্বর ও অন্ধকার যুগের যেসব অনাচার ও সীমালঙ্ঘন থেকে মানবজাতিকে সত্য ও সুপথের দিশা দিতে এসেছিলেন নবী হয়ে, এর মধ্যে নারীর প্রতি গুরুত্বারোপও ছিল অন্যতম। তৎকালে নারীর সম্পত্তি খুব সহজেই হারিয়ে যেত লোভী সমাজের হর্তকর্তাদের দখলে, ইসলাম এ বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এর প্রমাণ হলো, স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক অসংখ্য হুকুম আহকাম কেবল বিষয়টি নাযিল করেছেন এবং রাসূল সা. এর পূর্ণাঙ্গ ব্যাখা ও পদ্ধতি জানিয়েছেন। ব্যতিক্রম কেবল মিরাছের বেলায়, সুদীর্ঘ দুটি আয়াতে তিনি সব ধরণের শাখা প্রশাখা ভাগ করে বর্ণনা করে দিয়েছেন ছেলেমেয়েদের মধ্যে কে কখন কিভাবে সম্পত্তি থেকে অংশীদার হবে।
জীবনভর পড়ে গেলাম পবিত্র কুরআন, আহা! আদৌ কি এর মর্মকথা নিয়ে আমরা ভেবেছি। এ কুরআন তো কেবল হাতে নিয়ে পড়ার জন্য নয়, নিজের ভেতরটাকে এর রঙে সাজাতে না পারলে এ মুসলমানিত্বের মূল্য যে নেহায়েত সামান্য, তাও ভুলে বসে আছি আমরা। নারীদের বিষয়ে সতর্ক করার জন্যই পবিত্র কুরআনের একটি বৃহৎ সূরা নামকরণ করা হয়েছে তাদের নামে, তাদের অধিকার সম্পর্কে সতর্কবার্তা এসেছে বারংবার, তবুও কেন আমরা এত উদাসীন তাদের অধিকার ও প্রাপ্যসম্মানটুকু প্রদানের বেলায়?
এ সংক্ষিপ্ত লেখায় মেয়েদের সম্পত্তি বন্টনের মাসআলা বর্ণনা করা উদ্দেশ্য নয়, বরং এখনও যারা এ পাপে ডুবে আছি অবহেলায়, তাদেরকে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সামান্য ইঙ্গিত প্রদান করা। নিজেদের বোনদের সাথে এমন সর্বগ্রাসী আচরণ লোভ ও দখলদারিত্বের ঘুণে ধরা আমাদের বোধশক্তির এর চেয়ে ঘৃণ্য উদাহরণ আর কি হতে পারে? আপনার বোনের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া সামান্য চোখের পানি কাল কিয়ামতে পর্বত সমান অভিশাপ হয়ে দেখা দিবে- সে কথা ভুলে যেন না যাই আমরা সবাই।