অন্যান্য বিভাগ

লোকদেখানো লৌকিকতা বর্জনীয়

- তামীম রায়হান -

আজ রাজার বাড়ীতে দাওয়াত। এলাকার পীর সাহেব তার ছেলেকে সাথে নিয়ে রওয়ানা হলেন। যথারীতি পৌঁছলেন রাজপ্রাসাদে। নামাজের সময় হলে রাজার পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়লেন। তারপর ভোজসভা। রাজার পাশে বসে খেলেন। এবার ঘরে ফেরার পালা। ঘরে ফিরেই স্ত্রীকে ডেকে বললেন পীরসাহেব, কই গো! খাবার আনো, পেটের ক্ষুধা নিভেনি। 
সাথে থাকা ছেলেটি অবাক হয়ে বলে, আব্বাজান! আপনি না রাজপ্রাসাদ থেকে এই মাত্র খেয়ে এলেন। আবার খাবেন?
মুচকী হেসে পীর সাহেব বললেন, বাবা, রাজার পাশে বসেছিলাম তো, তাই বেশী করে খাইনি, পাছে রাজা আবার পেটুক বলেন কিনা! তাই। সামান্য কয়েক লোকমা খেয়েছি, তাই ক্ষুধায় আবার খাচ্ছি। ছেলেটি এবার মুখ খুলে বলে দিল, তাহলে তো আব্বাজান, নামাজও আবার পড়ে নিন। রাজার পাশে নামাজও হয়তো আজ আপনি তাকে দেখানোর জন্য সুন্দর করে পড়েছেন, আল্লাহর জন্য নয়। পীর সাহেব চুপসে গেলেন।
শুধু পীর সাহেব নয়, দিনে রাতে আমরাও অহরহ মানুষকে দেখানোর জন্য কত আমল করি। কৃত্রিমতা ও লৌকিকতায় আজ হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের একনিষ্ঠ আমল ও আল্লাহর জন্য নিবেদিত হওয়ার মন মানসিকতা। অথচ একমাত্র আল্লাহার জন্য উৎসর্গিত না হলে কোন আমলই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের সমাজে চারিদিকে আজ এমনই সৌজন্যের ছড়াছড়ি। মসজিদ কিংবা মাদ্রাসার দেয়ালে ঝুলে থাকা ঘড়ির গায়েও অঙ্কিত থাকে, এ ঘড়িটি দান করেছেন আলহাজ্ব আবুল কাসেম। নিজেদের দান দক্ষিণা প্রচার করে দানবীর সাজার এ প্রচার লড়াইয়ে সমাজপতিদের আগ্রহের কোন কমতি নেই।
রাসূলের যুগে সাহাবায়ে কেরাম একদিন বসে আলোচনা করছিলেন। রাসূল এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী নিয়ে তোমরা কথা বলছিলে, তারা জানালেন, আমরা দাজ্জালের প্রকাশ ও বিপদ নিয়ে কথা নিয়ে বলছিলাম। রাসূল বললেন, আমি তোমাদের জন্য দাজ্জালের চেয়েও কোন বিষয়টি নিয়ে বেশী আশংকা করি জানো? তা হচ্ছে, পরোক্ষ শিরক। অর্থাৎ মানুষ তখন দু রাকাত নামাজ এমন সুন্দরভাবে আদায় করবে যেন অন্যরা তাকে দেখে। (আহমদ, ইবনে মাজাহ)
লোকদেখানোর জন্য কোন আমল করার নাম রিয়া। হাদীসের ভাষায় এ বিষয়টিকে শিরকে খফী বা অপ্রকাশ্য শিরক বলা হয়েছে। মুসলমানের সব আমল তো একমাত্র আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত হবে, এর নাম ইখলাস। ইখলাস ও রিয়ার অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত দুই মেরুতে। কিয়ামতের মাঠে যে সাত প্রকার লোক আল্লাহ পাকের আরশতলে ছায়া পাবে, তাদের এক প্রকার এমন ব্যক্তি হবেন, যে এত গোপনে ডান হাতে দান করতো যে তার বাম হাতও তা জানেনা। প্রসিদ্ধ বুযুর্গ ও নবীর বংশধর যাইনুল আবিদীন বিন আলীকে মৃত্যুর পর যখন গোসল দেওয়া হচ্ছিল, তখন তার পিঠে ও কাঁধে রশির দাগ দেখে সবাই অবাক হলেন। তার স্ত্রীকে এর কারণ হিসেবে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানালেন, রাতের অন্ধকারে তিনি নিজের পিঠে খেজুর, কিসমিস, আটা, ময়দা বহন করে একাকী বের হতেন আর বিভিন্ন ঘরের সামনে গিয়ে সেগুলো রেখে আসতেন। তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ঐ পরিবারগুলোর কেউ জানতে পারেনি, কে প্রতি রাতে তাদের জন্য এসব খাবার রেখে যায়। যেদিন তার ইন্তেকালের কারণে তা বন্ধ হয়ে গেল, সেদিন সবাই জানলেন, কে ছিল রাতের আগন্তুক।
পবিত্র কুরআনের সূরা নিসা ও সূরা মাঊনে দু জায়গায় আল্লাহ পাক ঐ সব লোককে মন্দ বলেছেন, যারা লোক দেখানোর জন্য নামায আদায় করে। তাদেরকে মুনাফিকও বলা হয়েছে। রাসূল সা. সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, একটি ক্ষুধার্ত বাঘকে ছাগলের পালের মধ্যে ছেড়ে দিলে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, মানুষের মালের লোভ ও সম্মানের আশা তার দ্বীন ও আমলে এর চেয়ে বেশী ধ্বংস সাধন করে। (তিরমিযী)
যারা এখানে সেখানে ওয়াজ করেন, বক্তব্য দেন- তাদের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষের সামনে কোন বয়ান করে বা বক্তব্য দেয়, আল্লাহ পাক তাকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেন, এ বয়ানের পেছনে তার কী উদ্দেশ্য ছিল? (বায়হাকী) তিরমিযী শরীফের এক হাদীসে রাসূল সা. বলেছেন, যে কেউ আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশে ইলম শিখে (আলেম মাওলানা হয়) সে যেন জাহান্নামে নিজের ঠিকানা বুঝে নেয়। আরও ভয়ংকর বিষয় সম্পর্কে তিনি বলেছেন, জুব্বুল হাযান নামে জাহান্নামের একটি উপত্যকা রয়েছে, স্বয়ং জাহান্নাম তার কাছ থেকে প্রতিদিন একশ বার রক্ষা চায়। এ ্ভয়ংকর উপত্যকাটি ঐসব কুরআন পাঠকদের জন্য, যারা লোক দেখানোর জন্য আমল করে। (তিরমিযী)
সুতরাং সাধারণ মুসলমান কিংবা আলেম ওলামায়ে কেরাম, সবার জন্য এক চরম সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে এমন অসংখ্য হাদীসে। সামান্য যে কোন কাজও যদি মানুষের কাছে নিজের সম্মান ও মর্যাদা বাড়ানোর জন্য করা হয়, আল্লাহ পাক কিয়ামতের দিন সবার সামনে ঘোষণা করে তা প্রকাশ করে দিবেন। আর বলে দিবেন, যার জন্য আমল করেছিলে, তার কাছ থেকে এর প্রতিদান নিয়ে নাও। তাফসীরে ইবনে কাসীরে উল্লেখ রয়েছে, মানুষকে দেখানোর জন্য যতক্ষন কোন আমলে ব্যস্ত থাকলো, ততক্ষণ সে আল্লাহ পাকের অসন্তুষ্টির মধ্যে থাকলো। ইবনে মাজাহ শরীফের এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল বলেছেন, দুনিয়াতে যারা সুনাম সুখ্যাতির পোষাক গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আল্লাহ পাক কিয়ামতের দিন তাকে অপমানের পোষাক পরিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিবেন।
আমাদের মানসিক গতিপথ পরিবর্তনের জন্য এ কয়েকটি হাদীস যথেষ্ট। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা শীতার্তদের পাশে কম্বল বিতরণের জন্য ক্যামেরাম্যান সাথে নিয়ে যাওয়া, সামান্য ত্রাণ বিতরণের জন্য সারা এলাকায় দাতার নাম প্রচার করা, কথায় কথায় নিজের আমলের কথা অন্যকে শোনানো, আলহাজ্ব হওয়ার জন্য হজ্বে যাওয়া- আমাদের সমাজে এমন লোকের অভাব নেই।
তবুও সবার আগে নিজেকে সংশোধিত হতে হবে। আর কারো জন্য নয়, একমাত্র আল্লাহ পাকের জন্য নিবেদিত হতে হবে এক টাকা দান থেকে নিয়ে নিজে সব আমল ও ইবাদত। এ বিষয়টিও মনে রাখতে হবে, মানুষকে জানানোর কোন ইচ্ছাই হয়তো ছিলনা, তবুও যদি মানুষ জেনে যায়, তবে আশংকার কিছু নেই। এটি আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে বলে ধরে নিতে হবে।