শুধু রুকু সিজদার নাম নামায নয়
- তামীম রায়হান -
সেদিন আমার পাশে বসে রাগ ঝাড়ছিলেন এক ভদ্রলোক। যাকে নিয়ে তার এত রাগ আর
ক্ষোভ- তার কথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে তিনি আমাকে বললেন, এই
লোক আবার নামাজও পড়ে, কী লাভ এই নামাজের যদি ব্যবহারই ঠিক না হয়।
সেদিন আমিও থমকে গিয়েছিলাম তার উক্তি শুনে। সত্যিই তো, আমরা
কত মানুষকেই তো নামাজ পড়তে দেখি- কিন্তু কজন নামাজের দাবী মেনে জীবনের
সর্বক্ষেত্রে তা মেনে চলি। অফিসে আদালতে কত নামাযী ব্যক্তিই তো দায়িত্বে ফাঁকি
দিচ্ছে, ব্যবসায়ী ওজনে কম দিচ্ছে, নামাযী
কত মানুষ অহরহ মিথ্যা বলছে, অন্যকে ঠকাচ্ছে।
অথচ সৎ ভাবে জীবন যাপন, সত্য কথা বলা, অনাচার
ও অসত্য থেকে বেঁচে থাকা- এসবই তো নামাজের দাবী। শুধু দাবীই নয়, আল্লাহ
পাক তো বলেছেন, নিশ্চয় নামায অশ্লীল ও নিষিদ্ধ বিষয় থেকে
বিরত রাখে। (সূরা আনকাবুত-৪৫) কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে নামাযের এ ফলাফল প্রকাশ হয়
না কেন? নামায তো তো আমাদের মিথ্যা কথা ও খারাপ ব্যবহারকে বন্ধ করতে
পারছেনা। তবে কেন?
আমরা বেমালুম ভুলে আছি, নামায তো তখনই সব মিথ্যা ও অসত্য থেকে দূরে
রাখবে যখন তা সত্যিকারের নামায হবে। আরও সহজ ভাষায়, নিছক
নিয়ত করে রুকু ও সেজদার নামই কি নামায?
কয়েকটি
সূরা আর দুআর সম্মিলিত রূপ দিয়েই কি নামায?
আরেকটু গভীরে এসে বুঝুন। আমাদের প্রত্যেকটি আমল আল্লাহর কাছে পৌছে- এ কথা সত্য
ও অনস্বীকার্য। কিন্তু আমল করার গুণাগুণ এর উপর নির্ভর করে এর পরবর্তী রিপ্লাই ও
প্রতিফলন। যেমন নামায আমাদের উপর কর্তব্য। এখন কোনরকমে সঠিকভাবে তা আদায় করে কেউ
শুধু তার কর্তব্য আদায় থেকে দায়িত্বমুক্ত হল এবং বিনিময়ে সে কিছুই পেলনা, আরেকজন
দায়িত্বমুক্তির পাশাপাশি এর বিনিময়ে নির্ধারিত সওয়াবটুকুও পেল তার সঠিক আদায়
পদ্ধতির জন্য।
আরেকজন এর চেয়েও বেশী, তিনি তার ভেতরের আত্মিক সংযোগ এর ফলে শুধু
দায়িত্বমুক্তি ও সওয়াব নয়, বরং এর সাথে জড়িত ও ঘোষিত
সব বোনাস- যেমন বিশুদ্ধ আত্মার অনুভূতি,
রিযিকের
গ্যারান্টি, অশ্লীল ও অনাচার থেকে বেঁচে থাকার অফুরন্ত
শক্তি, প্রশান্ত চিত্ত,
সবার
জন্য কল্যাণকামী হৃদয়- এমন অসংখ্য গুণাবলী যা কেবল প্রকৃত নামাযীদের জন্য
প্রাপ্য- সব তিনি প্রাপ্ত হলেন। আর এ শ্রেণীর লোকের দু রাকাত নামায প্রথম শ্রেণীর
দু হাজার রাকাত নামাজের চেয়েও বেশী শক্তিশালী ও কার্যকর, দুনিয়াতেও
আখেরাতেও। সাহাবা ও বুযুর্গদের শ শ ঘটনা এর প্রমাণ। আল্লাহ পাক বলেছেন, ঐসব
ঈমানদাররা সফল যারা তাদের নামাযে একাগ্রচিত্ত ভীত। (সূরা মুমিনূন-১-২)
কিন্তু কীসের গুণে এ তারতম্য? কেন এ পার্থক্য? সরল
কথায়, নামায আদায়ের পদ্ধতির সঠিক জ্ঞান ও ব্যবহার, সূরা
কেরাতের বিশুদ্ধতা, ধীর স্থিরতা এবং নামায আদায়কালীন সময়ে
একাগ্রচিত্তে স্রষ্টাকে স্মরণ ও তার বড়ত্বের গুণাবলীর হৃদয়ে সার্বক্ষণিক
উপস্থিতি- এসবের সমন্বয়ে নামায তখন নিছক কেবল রুকু সিজদার নাম নয়, বরং
তা হয়ে ওঠে মহান রবের সাথে সরাসরি সাক্ষাত ও কথোপকথনের অপার্থিব স্বাদ ও অনাবিল
আনন্দের মাধ্যম।
এ নামাযই কেবল রুখতে পারে সব অনাচার ও অন্যায় থেকে। এজন্যই রাসূল সা. বলেছেন, নামায
শেষ করার পর কারো জন্য দশভাগের এক ভাগ সওয়াব লেখা হয়, কারো
জন্য নয় ভাগের এক ভাগ, আট ভাগের এক ভাগ.....কারো জন্য অর্ধেক অংশ লেখা
হয়। (আবু দাউদ) অন্যত্র বলেছেন, মানুষ যখন নামাযে অন্যদিকে
মনোযোগ দেয়, আল্লাহ পাকও তখন তার থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেন।
(নাসাঈ)
এজন্যই এক বুযুর্গ বলেছেন, আমাকে যদি বলা হয়, তুমি
জান্নাতে যাবে নাকি নামায পড়বে- আমি বলব,
দু
রাকাত নামায আমার কাছে জান্নাতের চেয়েও আনন্দময় মনে হয়। কারণ জান্নাত তো নিজেকে
নিয়ে মত্ত ও ফূর্তি করার জায়গা, আর নামাযে তো আমি স্বয়ং
জান্নাতের স্রষ্টার সাথে কথা বলতে পারি।’ নিজের অস্তিত্বের কথা এভাবে ভুলে যাওয়া কি খুব
সহজ?
এমনি কি আর আল্লাহর রাসূল বলেছেন,
নামাজ
মুমিন এর জন্য মিরাজ। অন্যত্র বলেছেন,
কিয়ামতের
দিন সর্বপ্রথম এ নামাযের হিসেব নেওয়া হবে,
যার
নামায ঠিক পাওয়া যাবে- তার সব আমল ঠিক,
যার
এ নামাযে ত্র“টি দেখা দিবে- তার অন্যান্য আমলও তেমনি হয়ে
পড়বে। (তাবারানী ও তারগীব)
কাজেই সংক্ষিপ্ত এ জীবনে যদি দু রাকাত নামাযও এভাবে আদায় করতে পারি, তবে
তখনই কেবল অনুভূত হবে আত্মিক স্বাদ ও আনন্দের অবর্ণনীয় অনুভব। যে অনুভবে ডুবে
গিয়ে সারা রাত কাটিয়ে দেন জায়নামাযে কত সাধক।