অন্যান্য বিভাগ


কুরআন শুধু তাবিজের জন্য নয়

- তামীম রায়হান -



আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে মহান স্রষ্টার তরফ থেকে প্রেরিত সর্বশেষ নবীর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল এক মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআন। যে কুরআনের ছোঁয়ায় উজ্জীবিত হয়ে সোনলী ইতিহাস গড়েছিলেন কিছু মাটির গড়া মানুষ, আমাদের সাহাবায়ে কেরাম। 
কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটে বারবার মনে জাগে, কেন নাযিল হল এ কুরআন? পবিত্র এ কুরআন কি শুধু আমাদের বরকত অর্জনের জন্য? নাকি একে চুমু দিয়ে বাচ্চাদের গলায় ঝুলিয়ে ভূত প্রেতাত্মা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য? অথবা সুন্দর মখমলের গিলাফে ভরে সাজিয়ে রাখার জন্য?
নয়তো হুজুর ডেকে খতম পড়িয়ে বিপদ আপদ থেকে উদ্ধার কিংবা পরীক্ষা বা চাকুরীর জন্য? নাকি রোগ বালাই থেকে মুক্তি পেতে সাধক কবিরাজের কাছে গিয়ে কুরআনপড়া পানি আনার জন্য?
আমাদের আজকের এ সমাজজীবনে কুরআনের ব্যবহার এ কয়েকটি ক্ষেত্রের জন্যই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে কেউ কেউ তসবীহ ও কুরআন হাতে মালাকুল মওতের অপেক্ষায় থাকেন।
এতো গেল মুসলমানদের কথা, যারা অমুসলিম কিংবা সন্দেহের ঘোরে ঘুরপাক খায়, তারা যাচাই বাছাই ছাড়াই কুরআনের একখানা তরজমা কিনে নিজেরা পড়ে, কেউ দিশা পেয়ে ফিরে আসে, কেউ আরও ক্ষুদ্ধ হয়ে ধর্মকে ফেলে দেয়।
আমরা কি কখনো ভেবেছি, কুরআনের মূল মর্মকথা কী? আল্লাহ পাক এ কুরআন দিয়েছেন মানবজাতির জীবনের সর্বস্তরে পথচলার গাইডলাইন হিসেবে। এর সর্বপ্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবজাতির হেদায়াত তথা সঠিক পথের দিশা ও মহান রবের পরিচয়।
এজন্যই কুরআনের সূচনায় বলা হয়েছে, এ এমন এক কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তাকিনদের জন্য তা হেদায়াতস্বরূপ। লক্ষ্য করুন, কুরআন থেকে উপকৃত হতে হলে সর্বপ্রথম হতে হবে বিশ্বাসী। বিশ্বাসী মুসলমান কুরআনকে যত অধ্যয়ন করবে সে ততবেশী উপকৃত হবে তার পার্থিব এবং অপার্থিব সকল কাজেকর্মে। 
যাদের হৃদয় কলুষতায় ভরা, অবিশ্বাস আর ষড়যন্ত্রে ঘেরা, তাদের ক্ষেত্রে এ কুরআন বরং তাদের মনের সংশয় ও রোগব্যাধিকে বাড়িয়ে দেয়। আল্লাহ পাক বলেন, যারা ঈমানদার, এ কুরআন তাদের ঈমানকে বাড়িয়ে দেয়, তারা তখন আনন্দিত হয়, আর যাদের হৃদয় অসুস্থ, তাদের জন্য তা বরং আরো নাপাকি বৃদ্ধি করে এবং অবশেষে তারা কাফের হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। (সূরা তওবা-১২৫)
আরেক আয়াতে তিনি বলেছেন, আমি অবতীর্ণ করেছি কুরআন যা মুমিনদের জন্য শেফা ও রহমতস্বরূপ, আর জালেমদের জন্য তা ক্ষতির কারণ ছাড়া আর কিছু নয়। (সূরা ইসরা-৮২)
এও মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞান বিজ্ঞান কিংবা আবিস্কারের সূত্র গবেষণা করে বের করার জন্য এ কুরআন নয়, যদিও সেসবের ইশারা কুরআনে বিদ্যমান, কারণ আল্লাহ পাক মানুষকে যে বিবেক বুদ্ধি দিয়েছেন- তা দিয়েই তারা তাদের প্রয়োজনীয় আবিস্কার ও গবেষণা সেরে নিতে পারবে, এজন্য কুরআনের আয়াত প্রয়োজন নেই, কিন্তু যেসব বিষয় মানুষের বুদ্ধি দিয়ে অর্জন সম্ভব নয় কেবলমাত্র সেসব বিষয়েই কুরআন পথ দেখিয়েছে, বারবার তাগিদ দিয়েছে। যেমন আল্লাহ পাকের পরিচয়, তার শক্তি ও বড়ত্ব, জান্নাত ও জাহান্নাম এবং নবীদের ঘটনা ও তাদের জাতিসমূহের পরিণতি ও পরিণাম। 
কুরআন নাযিলের এ মহান ও সর্বপ্রধান উদ্দেশ্য- মানুষের জন্য হেদায়াত ও জীবনপথের বিধিবিধান, এসব থেকে দূরে সরে গিয়ে কুরআনের পাতায় পাতায় গ্রহ নক্ষত্র ও শক্তির উৎস অনুসন্ধান করা আল্লাহ পাকের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, এ কথাও ঠিক যে, কুরআনে মর্মার্থ সঠিকভাবে ধারণ করার পর যদি আমরা সেসব নিয়ে ব্যস্ত হই তবে তখনও অসম্ভব নয় বিজ্ঞানের শীর্ষচূড়ায় আরোহণ, ইমাম রাযী, রুশদ ও ইবনে সিনা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। 
কুরআন শুধু বিপদ আপদ থেকে বাঁচার জন্য নয়, শুধু তেলাওয়াতের জন্যও নয়(যদিও এতে সওয়াব রয়েছে), নিছক ওয়াজ নসীহতের জন্যও নয়, কুরআনের প্রথম দাবী হচ্ছে এর আলোয় নিজেদের জীবনকে সাজানো। 
সেজন্য চাই কুরআনের সঠিক অনুধাবন, সঠিক অনুধাবনের জন্য প্রয়োজন নবীর সীরাত ও সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান- কারণ নবীর জীবন ও আদর্শ হচ্ছে কুরআনের প্রথম ব্যাখ্যা ও বাস্তব প্রতিফলন। তেলাওয়াতের জন্য চাই সহীহ শুদ্ধ পড়ার অনুশীলন। তবেই অনুভব হবে কুরআনের তাগিদ, জীবনকে ঢেলে সাজানোর ও এ জাতির পুনজাগরণের সেটাই প্রথম সোপান। 
তাই, শুধু রোগ বালাই থেকে নয়, জীবনের সর্বস্তরে কুরআনের সঠিক মর্ম অনুধাবন ও অনুসরণ আমাদেরকে রক্ষা করতে পারে পার্থিব ও অপার্থিব পতন ও ধ্বংসের ছোবল থেকে।