অন্যান্য বিভাগ

শুধু পড়লেই নয়,চাই সঠিক মর্ম অনুধাবন

-তামীম রায়হান -


ইসলামের বিধানসমূহের মধ্যে জিহাদ অন্যতম একটি বিধান। তবে এর জন্য রয়েছে বেশ কিছু শর্ত ও নিয়মাবলী। রয়েছে কিছু প্রারম্ভিক ভূমিকাও। এসব ভূমিকার মধ্যে রয়েছে- যে কোন শহরে সর্বপ্রথম ইসলামের দাওয়াত দিতে হবে, তাদেরকে এর সৌন্দর্য বুঝাতে হবে ও সময় দিতে হবে, যদি তারা না মানে তবে জিযিয়ার পয়গাম জানাতে হবে। জিযিয়া বলতে কর বা ট্যাক্স উদ্দেশ্য- এবং ঐ শহরের নিয়ন্ত্রণভার মুসলমানদের হাতে থাকবে। যদি শহরবাসী জিযিয়া দিতে চায়- তবে অমুসলিম
করপ্রদানকারী একজন মুসলমানের মতো সম্মান সুবিধা ও নিরাপত্তা পাবে। জিযিয়া প্রদানেও যদি শহরবাসী সম্মতি না দেয় তখন অস্ত্রের প্রশ্ন। যুদ্ধের দামামা কেবল তখনই বাজবে।
বৃটিশ শাসিত সময়ে এ উপমহাদেশের এক শিক্ষিত ভদ্রলোকের ঘটনা। সেকালে যে কজন মুসলিম যুবক উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতে গিয়েছিলেন- তিনি তাদের অন্যতম একজন। সেখানে গিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ইসলাম সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানার জন্য অধ্যয়ন শুরু করলেন। তখন রমজান মাস। এ অবসরে জিহাদের বিধিবিধান সম্বলিত একটি ফেক্বহী কিতাব নিয়ে তিনি পড়তে শুরু করলেন এর আহকামগুলো।
জিযিয়া অধ্যায়ে এসে তিনি চমকে গেলেন। আরে একী! এসব কী লেখা এখানে- যদি শহরবাসী জিযিয়া প্রদানে সম্মতি দেয় তবে মুসলমানরা যেন অস্ত্রের ব্যবহার থেকে বিরত থাকে। শহরের নিয়ন্ত্রণভার ছাড়া আর কোথাও কোন জবরদস্তি করা যাবে না।
ভদ্রলোকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। জিযিয়ার পয়সা পেয়ে এখানে জিহাদ স্থগিত হয়ে গেল!! এ কেমন ইসলামের বিধান! শহরবাসী পয়সা দিয়ে কর আদায় করার বিনিময়ে রেহাই পেয়ে গেল! তবে কি ইসলাম টাকা পয়সা অর্জনের জন্য জিহাদের বিধান দিল? এ কেমন ধর্ম! কেমন জিহাদ!!
উচ্চশিক্ষিত ভদ্রলোক খুব দ্রুত অতল ভাবনার গভীরে ডুবে গেলেন, একপর্যায়ে তার মনে এ লোভী ধর্মের জন্য ঘৃণা চলে এল। ছিঃ এই হচ্ছে ইসলাম! আর আমি এ ধর্মের সন্তান! নাহ, আমি এ ধর্ম মানতে পারছি না, ইসলাম আজ থেকে বাদ। জিযিয়ালোভী ইসলাম আমার দরকার নেই। ইসলাম যখন বাদ, কীসের আর রোযা রমজান, তিনি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে উঠে গিযে ঢকঢক করে পানি গিললেন কয়েক গ্লাস। কপালের ভাঁজ ঠিক হয়ে আসার আগেই তিনি মুরতাদ হয়ে গেলেন।
প্রতিদিনের মতো তিনি বিকেলে হাঁটতে বের হলেন, পার্কের যে রাস্তায় প্রতিদিন তিনি বের হতেন সেখানেই ছিল তার বন্ধুর বাসা। দুজন মিলে প্রতিদিন একসাথে হাঁটতেন,্ এরপর মসজিদে গিয়ে ইফতার করতেন। আজ তিনি যথারীতি হাঁটলেন, কিন্তু মসজিদের কাছে এসে তিনি দাঁিড়য়ে গেলেন, বন্ধুকে তার সব ঘটনা খুলে বললেন একরাশ ক্ষোভ আর দুঃখ নিয়ে। জানিয়ে দিলেন, তুমি যাও, আমি ইফতার করবো না, নামাজও পড়বো না। তুমি শেষ করে এসো, আমি এখানে আছি।
বন্ধুটি ছিলেন বিদ্যা বুদ্ধিতে তার চেয়ে অনেক কম। তিনি ভাবতে লাগলেন, ওকে নিয়ে পাশের কোন আলেম এর কাছে যাওয়া দরকার। ওর যে প্রশ্ন, এর সমাধান তো আমিও জানি না।
সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলে তারা দুজন মিলে একজন হযরতের কাছে গিয়ে পৌঁছলেন। ধর্মত্যাগী বন্ধুটির চেহারায় তখনো এসব আলেম আর ইসলাম নিয়ে তাচ্ছিল্যের ভাব। কথোপকথন শুরু হলে তিনি তার সমস্যা ও প্রশ্নটি তুলে ধরলেন, নিজের ক্ষোভ আর ইসলাম ছেড়ে দেওয়ার খবরও জানালেন।
প্রবীণ ঐ আলেম এর মুখে ততক্ষণে হাসির আভাস। তিনি বলতে লাগলেন কাঁেধ হাত রেখে, দেখুন, আপনার মতো অনেক শিক্ষিত ভদ্রজন নিজেরা পড়তে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন, নিজেদের অজান্তে তারা ধর্মকে ছুঁড়ে ফেলে দেন না বুঝেই। শুনুন, আপনি কি এখানে প্রদত্ত জিযিয়ার মর্ম নিয়ে ভেবেছেন? দেখুন, এ জিযিয়া দিতে সম্মত হলে শহরবাসী পূর্ণ নিরাপদে থাকবে, এর নিয়ন্ত্রণভার মুসলমানদের হাতে থাকবে, আর এ সময়ে তারা সবাই মিলেমিশে থাকবেন। মুসলিম অমুসলিম সমান সুবিধা ভোগ করবেন। আর এ মেলামেশায় মুসলমানদের উদারতা আর সরল সৌন্দর্য দেখে অমুসলিম নগরবাসী চিন্তা ভাবনায় এসব নিয়ে ভাববে, মুসলমানদের ভালোবাসায় মোহিত হবে, একসময় তারা ইসলামের ছায়াতলে চলে আসবে। আমাদের ইতিহাসে এর অনেক ঘটনা রয়ে গেছে। 
এমনও রয়েছে, দাওয়াত দেওয়া ছাড়া শহর জয় করার কয়েক বছর পর যখন দরবারের ফাইল ঘেঁেট এ ঘটনা জানা গেল, খলীফা নির্দেশ দিলেন পুরো মুসলিম বাহিনী যেন শহর ছেড়ে সীমানার বাইরে গিয়ে আবারও ইসলামের পয়গাম নতুন করে তুলে ধরে এবং তারা তা না মেনে নিলে জিযিয়া নয়তো জিহাদের পথ বেছে নেয় (বিস্তারিত জানতে আজারবাইজান বিজয়ের ইতিহাস দেখুন)। 
সুতরাং খলীফার নিদের্শমতো পুরো বাহিনী যখন নতুন করে শহর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াতের কথা তুলে ধরলেন, এতদিন যারা মুসলমানদেরকে দেখেছে, তাদের এ নিয়মানুবর্তিতা দেখে গোটা শহরবাসী ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিলেন।
এ কথাগুলো শুনতে শুনতে ভদ্রলোক তার ভুল বুঝতে পারলেন, তিনি অবাক হলেন হযরতের কথা শুনে এজন্যই আমাদের ফেকাহর কিতাবগুলো আমরা উসতাযদের কাছে পড়ি, যাতে প্রতিটি আহকামের মর্মকথা ও উদ্দেশ্য তারা বুঝিয়ে দেন। ইসলাম যদি নিজে নিজে পড়ে বুঝে ও শিখে ফেলার ধর্ম হতো- তবে যুগে যুগে শায়খদের কাছে গিয়ে মানুষ ইসলাম শিখতো না, সাহাবারা প্রতিদিন নবীর কাছে এসে হাতে কলমে তালিম নিতেন না।
এসব শুনতে শুনতে চোখে পানি চলে এল অনুতপ্ত ভদ্রলোকটির। তিনি তওবা করলেন, আবার কালেমা পড়ে ফিরে এলেন এ মহান ধর্মের ছায়াতলে- যার প্রতিটি হুকুমের একমাত্র উদ্দেশ্য মানব ও মানবতার কল্যাণ- পরিভাষায় যাকে বলে- মাছলাহাতুল ইবাদ। 
যারা ইসলাম ধর্মের ব্যাখা করতে গিয়ে ভুল ব্যাখ্যা করেছেন তাদের বেশীরভাগের একমাত্র কারণ হল- মাসায়েল বা হুকুম সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিজেদের যুক্তি ও বুদ্ধিমত বুঝতে চেয়েছিলেন তারা। তারা ভুলে গিয়েছিলেন, কুরআনের সব আয়াতই যদি নিজেরা বুঝে নেয়ার মত হতো তবে একজন ফেরেশতা দিয়ে কুরআন মানুষের কাছে পৌঁছে দিলেই হতো। একজন নবী তবে কেন পাঠালেন? নবীর কাজ ছিল আল্লাহর আয়াত মানুষের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া। ব্যাখ্যা করে বাস্তব প্রতিফলন শিখিয়ে দেওয়া।  
আর এজন্যই ইমাম গাযালী বলেছেন, ন্যায়সঙ্গত বিবেকের দাবী এবং ইসলামের সঠিক ব্যাখার মধ্যে কোন সংঘর্ষ কিংবা দ্বন্দ নেই। যা কিছু দ্বন্দ বা সংঘাত- এর মূলে হয়তো বিবেকের অপূর্ণতা বা ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা। কখনো কখনো এর পেছনে স্বার্থ ও সংকীর্ণতাও কাজ করে।
আমাদের আশেপাশেও প্রতিনিয়ত অনেক ভদ্র ও সুশিক্ষিত মহোদয় কেবল নিজেদের বিবেক নির্ভর ইসলামকে তাচ্ছিল্য করে হারিয়ে যাচ্ছেন ইরতিদাদের অতল সাগরে। সাধে কি আর আল্লাহ বলেছেন, যে রব তোমাকে সৃষ্টি করেছেন- তার নামেই পড়ন (নিজে নিজে নয়)।