অন্যান্য বিভাগ

প্রবন্ধ-নিবন্ধ

পরিবেশ বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা

তামীম রায়হান

আমাদের চারপাশের দিকে তাকালে দেখা যায়নিছক অসতর্কতা ও বেখেয়ালের বশে এখানে ওখানে পানের পিককলার ছোকলাবাদামের খোসা আর মুড়ির ঠোঙ্গা ফেলে ময়লা করছি নিজেদের পরিবেশএতে শুধু আমাদের চারপাশ নোংরা হচ্ছেনাকলুষিত হচ্ছে আমাদের মানসিক পরিবেশও। 
এমন অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্ন নোংরা পরিবেশে থেকে দিনদিন আমাদের ভেতরের দুর্বার শক্তিটুকুও হারিয়ে যাচ্ছেআমরাও ভুলে যাচ্ছি বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখার সাহস ও শপথের গান।
দিনদিন বাড়ছে বায়ুমন্ডলের গরম তাপমাত্রা, তীব্র হচ্ছে আমাদের আবহাওয়া। পরিবেশের এ ভয়ংকর পরিবর্তনে বিজ্ঞানীরা সত্যিই আতঙ্কিত। এ ভূমন্ডলের সাধারণ পরিবেশের  আমূল পরিবর্তন এবং বিশ্ববাসীর অসহনীয় দূর্দশার দুঃখজনক চিত্র দেখে সচেতন মানুষরা আজ বিচলিত।
এসব বিপদকে সামনে রেখে ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গঠিত হয় ইউনাইটেড ন্যাশনস এনভারনমেন্ট প্রোগ্রাম। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে এ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি বছর জুন মাসের পাঁচ তারিখ পালন করা হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস। বছর ও দেশভেদে এরা নতুন নতুন প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করে।
বিজ্ঞানীদের প্রায় সবাই একমত যে, পরিবেশের এ হুমকির অন্যতম কারণ গাছপালার সংখ্যা হ্রাস পাওয়া। মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে নির্বিচারে গাছ ধ্বংস করছে, এতে আমাদের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ এ গাছপালা আমাদের জন্য বাতাসে অক্সিজেন এর যোগান দেয় এবং কার্বনডাই অক্সাইড জমিয়ে রাখে। গাছপালা ধ্বংসের কারণে আমরা এ মহান প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
প্রযুক্তির বদৌলতে আজ আবি®কৃত হয়েছে নিত্য নতুন যন্ত্রপাতি। সেসব থেকে নির্গমন হচ্ছে ক্ষতিকর গ্যাস। দিনদিন বেড়ে চলা কল কারখানা থেকে নিষ্কাশন হচ্ছে রাসায়নিক পদার্থ এবং বিষাক্ত কেমিক্যাল। এসব মিলিয়ে বৃদ্ধি করছে পৃথিবীর উষ্ঞতা। বদলে যাচ্ছে আমাদের বায়ুমন্ডল এবং জলবায়ু। এতে গলছে বরফ এবং বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। তলিয়ে যাওয়ার ভয় তৈরী হচ্ছে নিচু দেশগুলোর অধিবাসীদের মনে, বাংলাদেশও বাদ নেই এ তালিকা থেকে। আমাদের আশেপাশের মালদ্বীপ, শ্রীলংকাও এ তালিকায় শীর্ষে।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, সাধারণত চারটি ক্ষেত্রে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে সবচেয়ে বেশী। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (১৯৯৫) এ চারটি ক্ষেত্র নির্ধারণ করেছে- বায়ুদূষন, শব্দদূষণ ও পানিদূষণ এবং মাটিদূষণ। সবমিলিয়ে এসবের পাশাপাশি গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়েও আশংকা বাড়ছে বিশ্বময়। এ বিষয় নিয়ে অনেক অনেক গবেষনা ও পরিসংখ্যান হয়েছে, এখনও হচ্ছে- কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে সামান্য।
অথচ আমরা বিশ্ববাসীরা আন্তরিক ভাবে চাইলেই এসব হুমকি কমিয়ে আনতে পারি। গাছপালা রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ এবং সচেতনতা তৈরী করা, কল কারখানার কালো ধোঁয়া থেকে পরিবেশ সুরক্ষার পদ্ধতি সম্পর্কে সজাগ রাখা, পাহাড় কাটা এবং নদী ভরাট বন্ধ করার জন্য সবার মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করা, বিষাক্ত দ্রব্য ও পদার্থ যত্রতত্র নিক্ষেপ করা থেকে সতর্ক করা, আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে বিলাস সামগ্রীর ব্যবহার কমিয়ে আনা- ইত্যাদীর মাধ্যমে আমরা প্রচেষ্টা চালাতে পারি একটি সুন্দর পরিবেশের নিশ্চয়তার জন্য।
প্রতিবছর এ দিনটি এলে বিশ্বের কত নামীদামী সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ এবং সংবাদমাধ্যম এগুলো নিয়ে নিজেদের মায়াকান্না প্রকাশ করে। কাঁচঘেরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেমিনার হলে বসে তারা নিজেদের পরিবেশ বিষয়ক গবেষণা ও কর্মপন্থা তুলে ধরেন। দিনের সূর্যাস্তের সাথে সাথে তাদের সব ভালোবাসা ও সচেতনতা বিদায় নেয়। এভাবেই চলছে পৃথিবী, আমাদের স্বার্থপরতার নিয়তি।
আমাদের মানসিক লোভ ও হিংসার আগুনে পুড়ছে পৃথিবীর পরিবেশ। গবেষক ও বিজ্ঞানীরা আমাদেরকে পরিবেশ রক্ষার উপদেশ দিয়ে থাকেন অথচ এর মূল উৎস ও কারণ থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখেন। মানসিক শুদ্ধতা এবং আল্লাহ পাকের নেয়ামত সম্পর্কে সচেতনতা ও কিয়ামতের দিন এসব বিষয়ে জবাবদিহীর ভয় অন্তরে না থাকলে এসব কাগুজে নীতিবাক্য আর বিধিমালা দিয়ে কী লাভ?
অনেকেই ভাবেন, জিহাদ-যুদ্ধ মানেই ধরো, কাটো, মারো, জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও..ইত্যাদী। অথচ দেখুন, আল্লাহর রাসূল সা. জিহাদে রওয়ানা করার আগে কী কী নির্দেশনা দিচ্ছেন, সাবধান, তোমরা নারীদেরকে হত্যা করবে না, কোন শিশুকে মারবে না, কোন অচল বুড়োকে আঘাত করবে না, আর তোমরা কোন গাছ কাটবে না, কোন গাছ আগুনে পুড়িয়ে দিও না, কোন ঘরবাড়ীকে ধ্বংস করো না।’’ জিহাদের মতো কঠিন পরিস্থিতিতেও প্রিয়নবী তার সেনানীদেরকে সতর্ক করছেন এসব বিষয় থেকে, অথচ নিজেদের পার্থিব লোভ ও দাবী আদায়ের জন্য আমরা গাছ কেটে ফেলছি, আগুন ধরিয়ে দিচ্ছি, পাহাড় কাটছি নির্বিচারে, অবৈধভাবে খাল ও জমি দখল করে ভরাট করছি, আমরা কি সেই নবীর উম্মত নই? পবিত্র কুরআনের বেশ কয়েক জায়গায় আল্লাহ পাক এ পরিবেশের কথা উল্লেখ করে নিজের নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যাতে বান্দারা এসব দেখে স্রষ্টাকে চিনে নেয়। এবং তিনি এমন লোকদেরকেই বুদ্ধিমান বলেছেন যারা তার সৃষ্টজগত নিয়ে ভাবে এবং তার কাছে কৃতজ্ঞতা আদায় করে।
রাসূল সা. আরও বলেছেন, কোন মুসলিম যদি কোন গাছ রোপন করে তবে এটি তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে (মুসলিম)। আরেক হাদীসে তিনি তাগিদ দিয়ে সতর্ক করে বলেছেন, তোমরা কোন গাছের ছায়ায় কিংবা রাস্তাঘাটে মলত্যাগ করবে না। তিরমিযী শরীফের এক হাদীসে সাদ রা. রাসূল সা. থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আল্লাহপাক পবিত্র এবং পরিচ্ছন্ন, তিনি পবিত্রতা এবং পরিচ্ছন্নতা ভালোবাসেন, তিনি দয়াবান, দয়া করাকে তিনি ভালোবাসেন, তিনি দানশীল, দান করাকে তিনি পছন্দ করেন। তাই তোমরা তোমাদের ঘরবাড়ির আঙ্গিনাকে পরিষ্কার করে রাখো, ইহুদীদের মতো হয়ো না।
এমন হাদীস ও আয়াত থেকে নির্দেশনা অনেক। কিন্তু এর কয়টি আমরা অনুসরণ করি, সেটিই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। আমাদের বাড়ীঘর কিংবা শিক্ষাঙ্গনের আশেপাশে এবং রাস্তাগুলো কি অপরিষ্কার ও নোংরা হয়ে আছে, ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে আছে এখানে ওখানে, আমরা কি চাইলে রাসূলের সত্যিকারের উম্মত হিসেবে নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে কয়েকজন মিলে এসব পরিস্কার করতে পারি না?
আমাদের চারপাশের দিকে তাকালে দেখা যায়, নিছক অসতর্কতা ও বেখেয়ালের বশে এখানে ওখানে পানের পিক, কলার ছোকলা, বাদামের খোসা আর মুড়ির ঠোঙ্গা ফেলে ময়লা করছি নিজেদের পরিবেশ, এতে শুধু আমাদের চারপাশ নোংরা হচ্ছেনা, কলুষিত হচ্ছে আমাদের মানসিক পরিবেশও। এমন অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্ন নোংরা পরিবেশে থেকে দিনদিন আমাদের ভেতরের দুর্বার শক্তিটুকুও হারিয়ে যাচ্ছে, আমরাও ভুলে যাচ্ছি বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখার সাহস ও শপথের গান।
প্রযুক্তি আমাদের অনেককিছু দিয়েছে এটি সত্য, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে এর চেয়ে বেশী এবং ঠেলে দিচ্ছে ভয়ংকর ভবিষ্যতের দিকে। প্রযুক্তির সাথে যোগ হয়েছে মানুষের কুপ্রবৃত্তি। এ দুয়ে মিলে অশান্ত করে দিচ্ছে আমাদের শান্ত সুন্দর সুজলা সুফলা পরিবেশটিকে।
এভাবে দূষিত পরিবেশ এখন হয়ে উঠছে আমাদের প্রধান শত্র। দূষণে দূষণে আজ উত্তপ্ত পৃথিবী, অতিষ্ঠ বিশ্ববাসী। তবুও যেন কোন পরোয়া নেই পরাশক্তিগুলোর। নিম্নভূমির দেশগুলোর দূর্দশা এবং বিশ্বময় গরীব মানুষগুলোর দূর্বিষহ জীবনযাত্রা তাদেরকে একটু ব্যাকুল করে না। কি নির্মম আমাদের নিয়তি।
আমি অনেক পরহেজগার ব্যক্তির মুখে এমন কথাও শুনেছি, ধূর যা, এসব গবেষণা ও ভাবনা দিয়ে কিছুই হবে না। আল্লাহর দুনিয়া আল্লাহ-ই বাঁচিয়ে রাখবেন। এ নিয়ে আমাদের মাথাব্যথার কিছু নেই। ও দায়িত্ব আমাদের না। আহা বেচারা! একটু সজাগ হয়ে দেখুন, কুরআন কিন্তু অন্যকথা বলছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের পরিবর্তনের সূচনা না করে। (সূরা রাদ-১১)
এ সুজলা সুফলা সবুজ পরিবেশ আল্লাহ পাকের দান। আমাদের জন্যই তিনি এসব সৃজন করেছেন এবং এসবের শুকরিয়া আদায় করতে বলেছেন। সুতরাং পরিবেশের প্রতি যতœবান হওয়া এবং অন্যকে সচেতন করার মাধ্যমে আমরা এ মহান নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারি।