অন্যান্য বিভাগ

প্রবন্ধ-নিবন্ধ

আত্মার অস্থিরতায় অশান্ত পৃথিবী

তামীম রায়হান


আত্মা এবং শরীর- এ দুয়ের সমন্বয়ে আমাদের অস্তিত্ব। দেহ ছাড়া আত্মার অস্তিত্ব এ পৃথিবীতে যেমন অকল্পনীয়, আত্মা ছাড়া শরীরও মূল্যহীন নিথর দেহ। মায়ের পেট থেকে এ দুয়ের যোগফল হিসেবেই আমাদের আগমন। তারপর ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা।
আমাদের এ মাটির শরীর হৃষ্টপুষ্ট হয় মাটি থেকে উৎপন্ন খাবার খেয়ে খেয়ে। চাল ডাল থেকে নিয়ে ফাস্টফুডের পিৎজা বার্গার, সবই তো এ মাটি থেকে নির্গত বন্তুর বহুরূপ। সেসবের মাধ্যমেই আমাদের এ শরীর সামান্য পুঁচকে থেকে কত বড় হচ্ছে। আমাদের এ দেহ বা আত্মার বহিরাবরণ যেভাবে বাড়ছে, এর সুস্থতা ও বেড়ে ওঠা নিয়ে আমরা যেভাবে নানা রকম কলাকৌশল নিয়ে যতœবান, এর ব্যস্ততায় আমরা ভুলেই বসে আছি আমাদের অস্তিত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের কথা, সেটিই হচ্ছে আত্মা। শুধুই কি গুরুত্বপূর্ণ, আত্মা ছাড়া তো আমাদের অস্তিত্বই নেই। প্রাণপাখি উড়ে গেলেই তো আমরা মরহুম, কাছের স্বজন বন্ধুরাও তখন কাছে ভিড়তে ভয় পায়।
এ আত্মা কিংবা রুহ বা প্রাণ- যাই বলিনা কেন, এটি আল্লাহ পাকের দান। আল্লাহ পাকের এক অলংঘনীয় বিধান। তার ইশারায় এ প্রাণের সব স্পন্দন। আমরা যতই ভুলে থাকি না কেন, এ আত্মারও কিন্তু রয়েছে কিছু চাহিদা ও প্রয়োজন। শরীরের সবগুলো অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মহারাজা এ আত্মাও কিন্তু ক্ষুধার্ত হয়, যদিও আমরা কোনদিন তার আকুতি শোনার চেষ্টা করিনি, অনুধাবন করিনি এর মৌলিক প্রয়োজনের কথা। বুখারী ও মুসলিম শরীফে রাসূল সা. তাই বলেছেন, এ আত্মা যদি ঠিক থাকে তবে পুরো শরীর ও কাজকর্ম সঠিক, আর যদি তা ব্যধিগ্রস্ত হয় তবে গোটা শরীর এবং এর কাজকর্ম নষ্ট হয়ে পড়ে।
মাটির তৈরী এ শরীরের যাবতীয় ক্ষুধা যেমনিভাবে মাটির ফসল দিয়েই নিবারণ হচ্ছে, এর রোগ বালাইও মাটির তৈরী নানাবিধ বস্তু থেকে সারছে, তেমনিভাবে উর্ধ্বজগত থেকে আগত বিরাজমান আমাদের আত্মার সব চাহিদা ও প্রয়োজন এবং তার সুস্থতা ও অসুস্থতা নিবারণের চজণ্য প্রয়োজন ঐ আসমানী আয়োজন। কি সেই আসমানী আয়োজন?
আকাশ থেকে যে মহান স্রষ্টা এ বিশ্ব চরাচর নিয়ন্ত্রণ করছেন, তার দেওয়া ফরমান ও বিধানের নামা আসমানী আয়োজন। আমাদের দ্বীন ইসলাম, পবিত্র কুরআন, রাসূলের ফরমান এবং সব ঐশী বিধান এ আয়োজনের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের আত্মা কিংবা প্রাণের আসল আহার সেটিই। যে সত্ত্বা এ আত্মার মহান স্রষ্টা, তার দেওয়া বিধানই এ আত্মার প্রধান বেঁচে থাকা। আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে এগারবার পরপর কসম খেয়ে বলেছেন, আত্মাকে যে পরিশুদ্ধ করলো সেই একমাত্র সফল হলো। আর যে তা থেকে বঞ্চিত থাকলো সেই দূর্ভাগা হলো।
এজন্যই ইসলামবিমুখ এবং আল্লাহভোলা আত্মাকে অসুস্থ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ইসলাম। পরম আল্লাহকে যে চিনেনি সে যেন নিজের আত্মার সাথে জুলম করেছে, কারণ সে তাকে তার প্রাপ্য দেয়নি- নিজের স্রষ্টার সাথে মিলিত হতে দেয়নি তার আত্মাকে।
প্রিয় পাঠক, কোন যুক্তি তর্ক কিংবা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দিয়ে নয়, আপনি নিজেই যাচাই করুন। একান্ত অবসরে যখন আপনি দু রাকাত নামাজ  শেষে মসজিদ থেকে যখন বের হয়ে আসেন, তখনকার সেই অনুভূতি আর সিনেমাহল থেকে বেরহওয়ার অনুভূতি কি কখনও সমান? প্রথমটিতে আপনি অনুভব করবেন এক ধরণের তন্ময়তা আর প্রশান্তি, আর পরেরটিতে অনুভূত হবে আরও চাই আরও চাইমূলক শুধুই ক্ষুধা আর লোভের অস্থিরতা। একজনকে নিঃস্বার্থ উপকারের প্রশান্তি আর আরেকজনকে ঠকিয়ে বিজয়ী হওয়ার অনুভূতি- এ দুয়ের মাঝে কোনটি আপনার আত্মার জন্য পরম অর্জন- কখনো ভেবে দেখেছেন কি?
এভাবেই সারাবছরজুড়ে আমরা ব্যস্ত থাকি এ শরীরের চাহিদা মেটাতে। নিজেদের আহার ও বাসস্থানের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে হন্য হয়ে ছুটি উদয়াস্ত সারাদিন। তবুও মেটেনা আমাদের চাহিদা, নিবারিত হয়না আমাদের ক্ষুধা, দিনদিন বাড়ে চাওয়ার তালিকা আর এসবের নীচে চাপা পড়ে থাকে আত্মার আকুতি, পরম করুণাময়ের সাথে তার মিলিত হওয়ার সুপ্ত বাসনা।
মানুষ তো বটেই, সাধারণ পশু পাখিরাও যেমন তার প্রয়োজনীয় আহার না পেলে হিংস্র হয়ে ওঠে, অস্বাভাবিক আচরণ করে আহত করে আশেপাশের সবাইকে, তেমনিভাবে আমাদের আত্মাও। এইযে বিশ্বময় আর চারিত্রিক ও নৈতিক এমন অধঃপতন, হেন কোন অন্যায় নেই যা আজ ঘটছেনা এ পৃথিবীতে, এর সবইতো ক্ষুধার্ত আত্মার গোঙানী। অতৃপ্ত আত্মা ধীরে ধীরে তখন রূপ নেয় পশুর মতো প্রবৃত্তির। শুধুই ভোগ আর আমোদ ছাড়া চর্মচোখে আর কিছুই পড়েনা তখন। এভাবে ক্রমশ মানুষের অধঃপতন পশুকেও ছাড়িয়ে যায়। সূরা আরাফের ১৭৯ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, এরা তো পশুর মতো বরং এর চেয়েও অধম, এরাই উদাসীন।
শারীরিক শক্তি কিংবা দেহবলে আমরা অনেক জন্তু জানোয়ারের চেয়ে পিছিয়ে। কেবল এই আত্মার শক্তিতেই আমরা আজ সৃষ্টির সেরা জীব। তাই শারীরিক সুস্থতা নিয়ে যেভাবে আমরা ভাবি, এর চেয়েও বেশি ভাবা প্রয়োজন আত্মার সুস্থতা নিয়ে। যুগ যুগ ধরে তাই বুযুর্গরা আলাদা করেছেন আত্মার রোগগুলোকে। হিংসা, পরনিন্দা, লোভ, অহমিকা এসবের অন্যতম। কোন কিছু চাষ না হলে বিরান ভূমি যেমন আগাছায় ছেয়ে যায়, আত্মার ভুমিতেও যদি সেভাবে তার চাহিদা মতো আল্লাহর যিকির এবং ইবাদতের চারা রোপিত না থাকে তবে সেখানেও এমনিভাবে আগাছায় ভরে উঠে। কলুষিত আত্মার কাছে তখন বিরক্তিকর অসহ্য মনে হয় সব ধরণের ন্যায়নীতির কথা।
হিংসা হানাহানি ও স্বার্থপরতার এ সময়ে আমাদের আত্মা সত্যিই ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত এবং কলুষিত।  হৃদয়ে হৃদয়ে যেদিন জেগে উঠবে আত্মার প্রকৃত পরিচয়, পৃথিবী সেদিন সত্যিই স্বর্গে পরিণত হবে। আমরা কি পারি না নিরব নিরালায় একাকী বসে মাত্র কয়েক মিনিট হলেও চোখ বুঁজে আত্মার এটুকু আকুতি শুনতে, তার চাহিদা ও প্রকৃত প্রয়োজনের ডাকে সাড়া দিতে?
আর তাইতো আল্লাহ পাক সূরা রাদে বলেছেন, মনে রেখো, একমাত্র আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমেই অর্জিত হবে আত্মার প্রশান্তি। হায় অশান্ত বিশ্ববাসী, এবার কি একটু ফিরে তাকাবে তোমার স্রষ্টার দিকে, শান্তির মূলমন্ত্র তিনিই তো বলে দিয়েছেন, আর কে পেরেছে এমন সহজ সমাধান শোনাতে?