অপচয় শুধু অপরাধ নয়
- তামীম রায়হান
আমাদের এ জীবন চলার পথের প্রতিটি সময় এবং এ পৃথিবীর সব সম্পদ একমাত্র আল্লাহ
পাকের দান। তিনিই এগুলোর একচ্ছত্র মালিক। আমরা কেবলমাত্র এসব থেকে উপকৃত হতে পারি।
এর বেশী কিছু নয়। তাই আমাদের যাবতীয় কাজকর্ম ও আচার আচরণ সেভাবেই হওয়া উচিত
যেভাবে আমাদের স্রষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সবচেয়ে বেশী যে বিষয়টি থেকে উদাসীন থাকি, তা হচ্ছে অপচয়। বাহ্যিক দৃষ্টিতে সামান্য ব্যাপার মনে হলেও মহান আল্লাহ পাকের
এ কাছে এটি অনেক বড় অপরাধ। সৃষ্টিকর্তার সম্পদকে যেনতেন ভাবে নষ্ট করার অধিকার
তিনি তো আমাদেরকে দেননি।
শুধুমাত্র প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা খরচ করার নামই অপচয় নয়। জীবনের প্রতিটি
কথা ও কাজে প্রয়োজনীয় সীমানা অতিক্রম করাকেই অপচয় বলে। আল্লাহ পাক এ সীমালঙ্ঘন তথা
অপচয় এবং কার্পণ্য- এ দুটো থেকেই বিরত থাকতে আদেশ দিয়েছেন। বরং তিনি
সর্বাবস্থ্য় সর্বকাজে মধ্যমপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। এজন্যই তিনি
আমাদেরকে নামকরণ করেছেন মধ্যমপন্থী উম্মত হিসেবে।
ধন দৌলত ও সম্পদ আল্লাহ পাকের দান। তিনি এসব দিয়ে আমাদেরকে জীবন ধারণের উপায়
করে দিয়েছেন। কেনাকাটা, খাওয়া দাওয়া থেকে নিয়ে
প্রতিটি স্তরে প্রয়োজনমতো খরচের আদেশ দিয়েছেন। গরীব অসহায়কে দান করতেও বলেছেন।
অপ্রয়োজনীয় খাতে অনর্থক কাজে এক পয়সা খরচ করলেও সেটিকে অপচয় হিসেবে গণ্য করেছে
ইসলাম।
সূরা আরাফের ৩০ নং আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ পাক বলেন, তোমরা খাও এবং পান করো কিন্তু অপচয় করবে না। আল্লাহ পাক অপচয়কারীদেরকে
ভালোবাসেন না। সূরা ফুরকানের ৬৭ নং আয়াতে তিনি মধ্যমপন্থী বান্দাদের প্রশংসা করতে
গিয়ে বলেছেন, তারা যখন খরচ করে তখন তাতে
সীমালঙ্ঘন করে না। সূরা ইসরার ২৭ নং আয়াতে তিনি অপচয়কারীদেরকে শয়তানের ভাই
হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সূরা ত্বহার ১২৭ নং আয়াতে তিনি কাফেরদের পরিচয় বর্ণনা
করতে গিয়ে বলেছেন, আমি এভাবেই তাদেরকে প্রতিদান
দিয়ে থাকি যারা অপচয় করে এবং তাদের রবের নির্দেশের প্রতি ঈমান আনেনি। সূরা
ইউনুসের ৮৩ নং আয়াতে আল্লাহ পাক ফিরাউনের পরিচয় দিয়েছেন, আর সে ছিল একজন অপচয়কারী। সূরা শুয়ারার ১৫১ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন, তোমরা অপচয়কারীদের কথা শুনবে না। আরেক আয়াতে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ও দূর্ভাগা
লোকদের নিন্দা করতে গিয়ে তাদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন এভাবে, তারা ছিল অপব্যয়কারী বিলাসী।
রাসূল সা. বলেছেন, তোমরা খাও ও পান করো এবং
পরিধান করো কিন্তু অপচয় কিংবা কার্পণ্য থেকে অবশ্যই বেঁেচ থাকো। (ইবনে মাজাহ)
যেটুকু হলে চলে এর চেয়ে বেশী খরচ করা এবং যেখানে খরচ করলে সত্যিকার কোন লাভ নেই
সেসব জায়গায় খরচ করার নাম অপচয়। আর প্রয়োজনীয় খরচের চেয়ে কম খরচ করাকে
কৃপণতা বলে। এ দুটো বিষয়ই ইসলামে সরাসরি নিষিদ্ধ। বরং মাঝামাঝি অবস্থানে থেকে
আল্লাহ পাকের দেওয়া যাবতীয় নেয়ামত ও দান উপভোগ করার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ পাকের
সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। এ অর্থেই হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, অপাত্রে এক টাকা খরচ করা হলেও সেটি অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত। বিখ্যাত তাবেয়ী ও
বুযুর্গ সুফিয়ান সাওরী রহ. বলেছেন, আল্লাহ পাকের নির্দেশিত পথ
ছাড়া অন্য কোথাও সামান্য খরচও অপচয়। শুধু কাজে নয়, কথায়ও অপচয় হয়। অনর্থক কথা বলে মানুষের নিন্দা করা, সমাজে অনিষ্ট সৃষ্টি করা- এমন যেকোন কথাও অপচয় হিসেবে গণ্য এবং আমলনামায়
গুনাহ হিসেবে ধর্তব্য।
মূলত অপচয়ের ক্ষয়ক্ষতি ও পরিণতি সম্পর্কে অজ্ঞতা, কিয়ামতের মাঠে মহান স্রষ্টার সামনে সম্পদের জবাবদিহিতার কথা ভুলে যাওয়া, বিলাসী ও উদাসীন লোকদের সাহচর্য, হঠাৎ বড়লোক হয়ে যাওয়া, নিজের বড়াই ও সুনম সুখ্যাতির লোভ লালসা ইত্যাদী থেকেই এ অপচয়ের সূত্রপাত।
সর্বোপরি যার হৃদয়ে নেই আল্লাহ পাকের ভয় ও তার দয়া ও করুণার প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং
অসহায় ও অভাবীদের জন্য সহমর্মিতা- তার পক্ষেই কেবল সম্ভব নিজের সম্পদ নিয়ে এমন
ধ্বংসাত্মক খেলায় মেতে উঠা।
নিজের রুমের লাইট ফ্যানের সুইচ এবং সাধারণ গ্যাসের চুলা থেকে নিয়ে আজ
রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও অপচয়ের কতরকম বাহারী উৎসবে নষ্ট হচ্ছে এ পৃথিবীর অমূল্য
সম্পদ। আমাদের দেশ ও পৃথিবী এবং অনাগত প্রজন্মকে আমরা নিজের হাতে ঠেলে দিচ্ছি শংকা
ও বিপদের দিকে। আজ বিশ্বময় ভূমিকম্প থেকে নিয়ে জলোচ্ছাস এবং বন্যা প্লাবনের মতো
যত দূর্যোগ এবং আপদ আসছে এর মূলে রয়েছে আমাদেরই স্বেচ্ছাচারিতা ও সম্পদ ব্যবহার
এবং পরিবেশ সংরক্ষণে নিদারুণ উদাসীনতা। এ পৃথিবীর একই আকাশতলে কত মানুষ দু মুঠো
খাবারের অভাবে কাঁদছে, আবার কত ধনীর দুলাল একাই
দশজনের খাবার ফেলে দিচ্ছে আবর্জনায়। শুধুই পার্থিব সামান্য সুখের জন্য অপচয় রোধ
করা নয়, বরং ক্ষণস্থায়ী এ কদিনের
জীবনঘড়ি থেমে গেলে আমাদেরকে দাঁড়াতে হবে এক পরাক্রমশালী মহান স্রষ্টা ও মালিকের
সামনে, সামান্য চারআনার হিসাবও যার কাছে গোপন নয়।
মনিষীরা বলেছেন, মানুষের ব্যয় দেখে বুঝা
যায় সে কিভাবে তা আয় করেছে। সত্যিই তাই। পাড়া মহল্লার কাঁচাবাজারে গেলেই দেখা
যায়, সবচেয়ে বেশি হাঁক দিয়ে কোন দরদাম ছাড়াই
ব্যাগভর্তি করে অপ্রয়োজনীয় সদাইপাতি কিনছেন যে লোকটি, মহল্লার অন্যতম এ লোকটি একজন কালোটাকার মালিক। শুধুই কি অপচয়, তার এহেন কর্মকান্ডে ক্ষতি হচ্ছে আশেপাশের আরও অনেক অসহায়ের। এমনকি হাদীসের
কিতাবসমূহে বলা হয়েছে, অত্যাচারী লোকদের অত্যাচারে
গাছের পাখিরও কষ্ট হয়, তাদের জুলুম অত্যাচারের
কারণে নেমে আসা আপদ বিপদে পশুপাখিরাও আর্তনাদ করে অভিশাপ দেয় এমন অসৎ মহাজনকে।
তাই আপনার অপচয় শুধু অপরাধ নয়, বরং অন্যের জন্য তা বিপদের
কারণও বটে। আর এর দায় এসে বর্তায় আপনার কাঁধেও।
তাই আসুন, এখন থেকেই মিতব্যয়ী হয়ে
আত্মত্যাগের প্রস্তুতি নিই জীবনের সর্বস্তরে। আশেপাশের অসহায়ের পাশে দাঁড়িয়ে
নিজেদের দায়িত্বটুকু আদায়ে এখনই তো সচেতন হওয়ার সুবর্ণ সময়।