অন্যান্য বিভাগ


শিশুদের জন্য ভালোবাসা

- তামীম রায়হান -



নামাযের সময় হয়ে এসেছে। তাই রাসূল সা. ছুটছেন মসজিদের দিকে। একা নয়, তার কোলে প্রিয় নাতিদ্বয়। হাসান ও হোসাইন। তাদেরকে কোল থেকে নামিয়ে তিনি নামায শুরু করলেন। নামাযের কোন এক সিজদায় তিনি অনেকক্ষণ ধরে সিজদাবস্থায় থাকলেন। স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও অনেকক্ষণ বেশী। কিছু ঘটে গেল কিনা, এ আশংকায় এক সাহাবী সিজদা থেকে উঠে সামনের দিকে তাকালেন। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেন, একটি শিশু তার পিঠে চড়ে বসে আছে। এ দেখে তিনি আবার সিজদায় চলে গেলেন।

নামায শেষ হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আজ যে নামাযের মধ্যে এত লম্বা সিজদা করলেন! আমরা তো ভেবেছিলাম কিছূ ঘটে গেল নাকি ওহী নাযিল হচ্ছিল। রাসূল বললেন, এসবের কিছুই হয়নি। ঐ আমার নাতি আমার পিঠে চড়ে বসেছিল। আমি তাকে নামিয়ে দিয়ে উঠতে চাইনি। সে তার খেলা শেষ করে নামার পর আমি মাথা উঠিয়েছি। (ইমাম আহমদ আব্দুল্লাহ বিন শাদ্দাদের সূত্রে তার বাবা থেকে বর্ণনা করেছেন)
প্রিয় পাঠক, ভাবা যায়! স্বয়ং আল্লাহর রাসূল এক ছোট্ট শিশুর জন্য কীভাবে তাকে নামাযেও সুযোগ করে দিলেন। তাঁর হৃদয়ভরা মমতা ও আদরের এমন ব্যবহার দেখে অবাক হয়ে পুলকিত হতেন খোদ সাহাবায়ে কেরাম।
আরেকদিন। আকরা বিন হাবিস নামের এক সাহাবী রাসূলের কাছে এসে দেখেন, তিনি পরম ভালোবাসায় জড়িয়ে শিশু হাসানকে চুমো দিচ্ছেন। আকরা বলে উঠলেন, আমার তো দশটি সন্তান, আমি কিন্তু কাউকে এভাবে চুমো দেইনি। রাসূল সা. বললেন, মানুষকে যে দয়া করেনা, আল্লাহও তাকে দয়া দেখান না। (মুসলিম) শিশুকে ধাপে ধাপে কীভাবে তাকে গড়ে তুলতে হবে, তা তিনি শিখিয়েছেন, বলে গিয়েছেন অনাগত উম্মতের জন্য।
শিশুদের জন্য তার মায়া ও আদরভরা ভালোবাসার কথা সাহাবায়ে কেরামও অনুভব করতেন। তাই তাদের যে কারো সন্তান হলে প্রথমেই নিয়ে আসতেন আল্লাহর রাসূলের কাছে। রাসূল শিশুটিকে কোলে তুলে নিতেন, তারপর সামান্য কিছু নিজের মুখে চিবিয়ে বাচ্চাটির মুখে দিতেন। তারপর তার জন্য দুআ করে দিতেন, আল্লাহ পাক যেন বরকত ও কল্যাণ দিয়ে তাকে ঘিরে রাখেন সবসময়। 
হযরত আনাস রা. বলেন, আমার ছোট একটি ভাই ছিল। রাসূল সা. যখন আমাদের কাছে আসতেন, তাকে দেখলেই বলতেন, হে আবু উমায়ের, কই গেল তোমার নুগায়ের!! (নুগায়ের হচ্ছে ছোট পাখি, যা দিয়ে সে খেলতো) (বুখারী)
মানুষকে দাওয়াত দেওয়া, তাদেরকে দ্বীন শেখানো, নিজের ইবাদত, ইসলামের জন্য জিহাদের কৌশল, মদীনার রাষ্ট্র পরিচালনা, বিচার আচার, সাহাবায়ে কেরামের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান- এতসব বিস্তৃত ও ব্যস্ত কাজে থেকেও তিনি শিশুদের সাথে মিশতেন। তিনিও তখন যেন শিশু হয়ে তাদের সাথে হাসি খেলায় মেতে উঠতেন। তাদেরকে কোলে তুলে নিতেন পরম মমতায়।
একদিন রাসূল সা. এর কাছে কিছু পানীয় আনা হল। তার ডান দিকে একটি ছেলে বসা, কিন্তু বামদিকে সম্মানিত কয়েকজন ব্যক্তি। মজলিসের নিয়ম অনুযায়ী রাসূলের পর ডান দিক থেকে সবাই ঐ পাত্র নিয়ে পান করতো। কিন্তু বড় কয়েকজন যে বামদিকে বসা, রাসূল তাই ডান দিকের ছোট ছেলেটিকে বললে, তুমি কি আমাকে অনুমতি দিবে বামদিকের লোকদেরকে আগে দেওয়ার জন্য? ছেলেটি বলে উঠলো, না না, আমি আপনার চেয়ে আর কারো জন্য আমার অংশ ছাড়তে রাজি নই। রাসূল তাই তার হাতেই তা দিয়ে দিলেন। (বুখারী)
এমন ভরা মজলিসেও ছোট বাচ্চাটিকে এভাবে গুরুত্ব দিয়ে তার কাছে অনুমিত চাওয়া, তাকে তার অংশের গুরুত্ব বুঝতে দেওয়া- কীভাবে নিজের প্রাপ্য নিতে হয়- এগুলো শিখিয়ে দিতেন আল্লাহর রাসূল। এমন অসংখ্য ঘটনা ও বর্ণনা রয়েছে হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থসমূহের পাতায় পাতায়।
শুধু সাহাবায়ে কেরামের সন্তান বলে নয়, কাফের ইহুদীদের সন্তানকেও তিনি ভালোবাসতেন। হযরত আনাস বলেন, এক ইহুদীর ছেলে রাসূলের কাছে থাকতো, তাঁর কিছু কাজ করে দিত। ছেলেটি একবার অসুস্থ হল, রাসূল তাকে দেখতে এলেন। তার মাথার কাছে বসলেন। তাকে বললেন, তুমি ইসলাম গ্রহণ করো। সে তার বাবার দিকে তাকায়, বাবা তার কাছেই বসা ছিল। ইহুদী লোকটি তার ছেলেকে বলল, আবুল কাছেম (মুহাম্মদ সা. এর উপনাম) যা বলে, তা মেনে নাও। ছেলেটি কালেমা পড়ে ইসলাম কবুল করে নিল। রাসূল সা. খুশী হয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিলেন, তিনি বললেন, সব প্রশংসা ঐ আল্লাহর যিনি এ ছেলেটিকে আগুন থেকে রেহাই দিয়ে দিলেন। (বুখারী)
বিধর্মীর সন্তানের জন্যও কত প্রবল তার ভালোবাসা, তার পার্থিব ও অপার্থিব সফলতার জন্য কেমন ব্যাকুলতা। ছোট্ট ছেলেটির অসুস্থতার খবর শুনে ছুটে গেলেন তার কাছে, এক ইহুদীর ঘর পর্যন্ত। সাধারণ মুসলমান তো বটেই, আজকের পীর মাশায়েখরাও এসব ব্যাপারে নাক কুঁচকিয়ে এড়িয়ে চলেন।
রাসূল জানতেন, আজকের ছোট শিশু আগামীর কারিগর। কাজেই তাকে আদর ও ভালবাসায় সুযোগ্য উম্মত হিসেবে গড়ে তুলতেন তিনি। ইসলামের জন্য যাদের মন আনচান করে সবসময়, আমাদের কজন শিশুর প্রতি এভাবে দায়িত্ব পালন করি? কিংবা তাদের মানসিক বিকাশ ও চারিত্রিক গঠন নিয়ে ভাবি?