অন্যান্য বিভাগ

ভাবনা

ধর্ম ও ধার্মিকতার প্রকারভেদ- পরিচয় ও পরিণাম

- তামীম রায়হান -


আমাদের এ সমাজে দু ধরণের ধার্মিক রয়েছেন। প্রথম শ্রেণীর ধার্মিক হচ্ছেন, যারা ধর্ম চর্চা করেন পরিমিত মাত্রায়, জেনে বুঝে, গোঁড়ামী ও সংকীর্ণতার বাইরে থেকে, অন্যকে উৎসাহ দিয়ে। তারা ধর্মের জন্য মায়া ও ভালোবাসার বীজ বুনে দেন পরবর্তী প্রজন্মের মনমানসে, এদের কেউ হয়ত আলেম, কেউ বংশপরস্পরায় ধর্মের আবহে বেড়ে উঠেছেন সঠিক পরিচর্যায়।

আরেক শ্রেণী রয়েছেন যারা ধর্মের প্রতি আকস্মিকভাবে আসক্ত হয়েছেন কোনো কারণে। হয়তো তাবলীগে গিয়ে, কিংবা কারো মুরিদ হয়ে, নয়তো কোনো প্রিয়জনের মৃত্যুতে অথবা বুড়ো বয়সে মৃত্যুর কাছাকাছি এসে।

আল্লাহ পাক ইসলামকে আমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে মনোনীত করেছেন এবং তিনি পবিত্র কুরআনে বারবার কয়েক জায়গায় বলেছেন, তিনি তোমাদের জন্য এ ধর্মে কোনো কষ্টকর কিছু রাখেননি। অন্যত্র বলেছেন, তিনি তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, মানুষ তো দুর্বল। আরেক জায়গায় বলেছেন, আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ কাজ দিতে চান, কঠিন কিছু তোমাদের জন্য তিনি পছন্দ করেননি। এভাবে তিনি নিজের সত্ত্বা ও আদেশের কাঠিন্য থেকে মানুষকে অভয় দিয়েছেন। রেহাই দিয়েছেন মনের বিরুদ্ধে ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া থেকে।

ইসলাম যদি এতই সহজ ও সুন্দর হয় তবে মুসলমানরা ধর্মবিমুখ হচ্ছে কেন? পরহেজগার মা বাবার সন্তান বখাটে হচ্ছে কেন? ধর্ম নিয়ে কেন এই বিদ্বেষ, নাস্তিক আর আস্তিকের লড়াই? এত সুন্দর ধর্ম কেন পরিবারে বিবাদের কারণ? দেশে হানাহানি ও গালিগালাজের কারণ

আমাদের দুর্ভাগ্য, আরব থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের এই বাংলাদেশে এই সমস্যার কারণ দু দিক থেকে সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামকে যারা প্রকৃত অর্থে বুঝেছেন তাদের নির্লিপ্ততা আর যারা একটু আধটু বুঝেছেন তাদের অতিমাত্রার ভন্ডামী বিপদে ফেলেছে এমন এক বিশাল সমাজকে যারা ধর্ম সম্পর্কে কিছুই জানে না। 


লেখার শুরুতে উল্লেখিত প্রথম শ্রেণীর লোকজন থাকেন প্রচারের আড়ালে, নিজেদের দেয়ালের ভেতরে, নিজেদের আমল আর কায়কারবার নিয়ে তারা ব্যস্ত। সবাই তাদেরকে দূর থেকে দেখে, কিছ্ইু আহরণ করতে পারেন না।


আর যে ২য় শ্রেণী রয়ে গেল, এ ধার্মিক শ্রেণীটি সমাজের সর্বস্তরে মিশে থাকেন। হঠাৎ করে ধর্মের আলো পেয়ে তারা নড়েচড়ে বসেন, লাফ দিয়ে আঁকড়ে ধরেন ধর্মকে। 

আর এ লাফালাফিতে বিরক্ত হয় তাদের কাছের মানুষগুলো, এ বিরক্তির তীর গিয়ে লাগে ইসলামের গায়ে। আকস্মিক ধর্মপ্রাপ্তিতে ব্যস্ত এ শ্রেণীর লোকজন ধর্মের যে কোণা দিয়ে এ গন্ডিতে ঢুকেছে, সে তার ঐ ছিদ্রপথকে পুরো ধর্ম ভেবে তা নিয়ে ঢোল পেটাতে ব্যস্ত হয়, এটাই ইসলাম, আর বাকীসব ভন্ডামী এ মনোভাবে কেটে যায় তাদের দিবারাত্রির আমল। ইসলামের বিশাল আঙিনায় প্রবেশের কোনো তাগিদ তারা অনুভব করেন না। 

ইসলামের সামান্য যে কোন অংশ যা তারা বুঝেছেন, পীর মুরিদী কিংবা তাবলীগ কিংবা অন্য যে কোন পন্থায়- এর সবগুলো হচ্ছে ইসলামের ব্যাপক বিস্তৃত অঙ্গনে প্রবেশের ছোট ছোট দরজা। এ দরজাটুকু পেরিয়ে যারা ভেতরে আসতে পেরেছেন, তারা এ ধর্মের অপার মহিমা, উদারতা ও সৌন্দর্যবোধ দেখে পুলকিত হয়েছেন, অস্থিরতার বদলে তারা তখন ভাবুক হন, জানা অজানার রাজ্যে তারা বিনয়, কোমলতা, উদারতা ও মহৎ হতে শেখেন আসমানী নূরের ছোঁয়ায়।


কোন পীরের মুরিদ হয়ে ঘরে এসেই লাঠি হাতে ঘরের টেলিভিশনটা যদি কেউ ভেঙ্গে ফেলেন, তাবলীগের চিল্লা দিয়ে ঘরে ফিরেই ছেলে মেয়ের স্কুল কলেজ বন্ধ করে মাদরাসায় পাঠাতে চান, হজ্ব করে এসেই সব কায়কারবার বন্ধ করে বৈরাগী সাজেন, তবে এসব কাজকর্ম অতি ধার্মিকতার ক্ষতিকর বিস্ফোরণ ছাড়া আর কিছু নয়, এ বোম ফাটানীতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার পরিবার, বন্ধুজন এবং স্বজন। সবাই তখন ইসলামকে দেখে তার পরিবর্তিত আচরণের আয়নায়, সবাই ভাবে এটাই বুঝি ইসলামের প্রবেশপদ্ধতি। আশপাশের মানুষগুলোর চরম বিরক্তি আর আড়াল থেকে টিপ্পনী ও তির্যকের তীর গিয়ে ছুটে পবিত্র ইসলামের সীমানায়।


আদৌ কি ইসলাম এভাবে কারো উপর এভাবে ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া সমর্থন করে? মোটেও নয়। আল্লাহ একাধিক জায়গায় তাগিদ দিয়েছেন, আপনি আপনার রবের দিকে মানুষকে ডাকুন হিকমতের সাথে সুন্দর উপদেশ দিয়ে, ঝগড়া করতে হলেও তা উত্তমভাবে করুন।

আরেক জায়গায় বলেছেন, হে নবী, আপনি বলে দিন, এটাই আমার রাস্তা, আমি মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকি জেনে বুঝে, আমার অনুসারীরাও।


আমাদের নবীর জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায়, নিজের আত্মীয় স্বজনকে ইসলামের দিকে ডাকার জন্য তিনি কতো ভাবে তাদেরকে আকৃষ্ট করেছন। কারো উপর তা চাপিয়ে দেননি। তিনি সবসময় মানুষের অন্তরে অন্তরে এই ধর্মের সৌন্দর্যের বীজ বুনে দিতেন তার অপূর্ব চরিত্রের মাধ্যমে, সর্বসুন্দর ব্যবহারের কোমলতায় তিনি তার আদর্শের মায়াজাল ছড়িয়ে দিতেন অন্যের হদয়জগতে।

পিঠে থাপ্পর মারার চেয়ে ভালোবাসার হাত বুলানোর প্রভাব যে কতো কার্যকর ও সুদূরপ্রসারী- রুক্ষ কঠিন মূর্তিপূজারী আরবদের বিপদসংকুল ও হিংস্র সমাজে মাত্র তেইশ বছরের নবী জীবনের সফল কর্মপদ্ধতি ও এর বাস্তব ফলাফল গভীর ভাবে তাকালে তা স্পষ্ট হয়ে উঠে। যে নবীর ইসলামের ভালোবাসায় আকস্মিক ধার্মিকরা লাফালাফি করেন, অন্যকে পদাঘাত করেন, তারা কিন্তু ধর্মের প্রাণপুরুষের জীবনীটুকুও কোনদিন ভালভাবে পড়ে দেখেননি। নিছক পীর কিংবা মুরব্বী অথবা আধো আধো জ্ঞানের কোন মৌলভীর কাছে শোনা কয়েকটি বাণী জপে জপে তারা বাকী জীবন কাটিয়ে দেন, এর সাথে ছিন্নভিন্ন করে দেন নিজের ছেলে কিংবা কোন স্বজনের মনের গহীনে লালিত ধর্মের জন্য তার ভালোবাসাটুকু। এই কর্তার অতিধর্মপরায়ণতার এ দায় কার? এখানে গুরু ও শিষ্য সমভাবে দায়ী। এ সমস্যার উৎসমুখ তাই দুটো। আর এ দুয়ের মাঝে পড়ে ইসলামের ঘাড়ে চাপে যত নিন্দা আর অপবাদ।


পাকিস্তানের প্রথম প্রধান মুফতী তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন সহ অসংখ্য গ্রন্থ রচয়িতা মুফতী শফি রহ. এর নাম কে না শুনেছে? একবার তিনি খাওয়ার রেস্তোরায় গিয়ে ঢুকলেন কোনো এক সফরে। তার সাথে থাকা সঙ্গীরা তাকে বলল, হুজুর, আমরা রেস্তোরা মালিককে বলে আপনার সম্মানে এখানে মাটিতে বসে সুন্নত তরীকায় খাওয়ার ব্যবস্থা করি? আপনি টেবিলে বসে খাবেন, তা কী করে হয়?

হযরত মুফতী তখন তাদের এমন জোশ থামিযে দিয়ে বললেন, দেখো, আমরা যদি এখানে মাটিতে বসে দস্তরখান পেতে খেতে বসে পড়ি, এটা দেথে অনেক মানুষ এ সুন্নতের গুরুত্ব না জেনে হয়তো হাসাহাসি করবে, নয়তো টিটকারী করবে আমাদেরকে নিয়ে। এতে তারা সবাই গোনাহগার হবে। আমরা একটি সুন্নত মানতে গিয়ে অনেকগুলো সাধারণ মানুষকে সুন্নতের প্রতি হাসিতামাশাকরী বানিয়ে গোনাহগার করে কী লাভ? রেস্তোরায় যেহেতু এসেছি, এখানের ব্যবস্থা অনুযায়ী খেয়ে নেয়াই ভালো। খাবার কিনে ঘরে নিয়ে গেলে তখন সম্পূর্ণ সুন্নত নিশ্চিন্ত মনে আমল করো। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়া, এর নাম হিকমত।


আসুন ইসলামকে মানি জ্ঞানের সাথে সৌন্দর্যবোধ মিশিয়ে, অন্যকে তা মানতে শেখাই মায়া ও ভালোবাসা জাগিয়ে। বন্ধ হোক ধর্মের নামে সব চাপানো কুসংস্কার, ধর্মের নামে সব কলহ বিবাদ।