ওজনে কম দিলে কী হবে?
- তামীম রায়হান -
এ মৌসুমে বাংলানিউজে একটি খবর দেখে
অবাক হলাম। খবরে বলা হয়েছে, ‘এ মৌসুমে রাজধানীতে প্রতিদিন
প্রায় আড়াই কোটি থেকে তিন কোটি লিচু বিক্রি হয়। সেই হিসেব মতে প্রতি একশ লিচুতে ১৫-২০
টি করে কম দিলে তিন কোটি লিচুতে কম দেওয়া হয় ৪৫ লাখ থেকে ৬০ লাখ লিচু। প্রতিটি লিচুর
গড় মূল্য তিন টাকা ধরলে খুচরা লিচু ব্যবসায়ীরা শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন ক্রেতাদেরকে
১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ঠকাচ্ছেন।’ বাকী জেলাগুলোর কথা না হয় বাদ-ই
দিলাম।
পাড়া মহল্লার কাঁচাবাজারের ‘সামান্য কাঁচামরিচ’ থেকে নিয়ে
মাংসের দোকানে ‘গরুর নামে মহিষে’র কারবার কিংবা ‘অভিজাত ফাস্টফুড’ দোকানের ভেজাল থেকে নিয়ে ‘রাষ্ট্রীয় টেন্ডার ঠিকাদারী’- সর্বত্র
আজ ধোঁকাবাজি ও অন্যকে ঠকানোর মহোৎসব। নৈতিকতা বিবর্জিত এমন আকাল মহামারীর মধ্যেও এসব
প্রতারক আর দূর্নীতিবাজরা যে এখনও সুস্থাবস্থায় দিব্যি বেঁচে আছেন- এ যেন আল্লাহ পাকের
অপরিসীম ধৈর্যের সামান্য নমুনা। আর এ অসুস্থ সমাজে আমাদের অসহায় বেঁচে থাকা দেখে মনে
পড়ে রাসূল সা. এর দুআর কথা। মহান আল্লাহর কাছে তিনি মিনতি জানিয়েছিলেন, ‘গুটিকয়েক মানুষের পাপের কারণে তুমি আমার পুরো উম্মতকে ধ্বংস
করে দিওনা।’
আমাদের পারস্পরিক লেনদেনের ক্ষেত্রে
কিছু বিষয় এমন রয়েছে, স্বয়ং আল্লাহ পাক সেগুলোর কারণে
অত্যন্ত রাগান্বিত হন এবং এগুলোতে তিনি বিন্দুমাত্রও ছাড় দিতে রাজি নন। এসবের অন্যতম
একটি হল, ক্রেতাকে ওজনে কম দেওয়া। ওজনে কম দেওয়া বলতে শুধু দাড়িপাল্লা
আর বাটখারার কথা নয়, ক্রেতাকে যে কোনভাবে ঠকানোর কথা বুঝানো হচ্ছে।
চাই তা সংখ্যায় কম দেওয়া হোক, কিংবা গুণগত মানে ঠাকানো হক। এসব
ভিন্নতা বুঝানোর জন্য আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে ‘তাতফীফ’ এবং ‘বাখছ’ শব্দসমূহ ব্যবহার করে সবগুলো প্রকার
স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
ইসলাম এ বিষয়ে কতটা সোচ্চার এর সামান্য
প্রমাণ হল, এমন লোকদের পরিণতি সম্পর্কে নামকরণ
করা হয়েছে পুরো একটি সূরার। ‘সূরা আল মুতাফফিফ’। সূরাটির সূচনা থেকে কিছু আয়াত- ‘ধ্বংস ও দূর্ভোগ ঐ সব লোকদের জন্য, যারা ওজনে কম দেয়। তারা যখন অন্যের কাছ থেকে কোনকিছু নেয়,
তখন তা পুরোপুরি ওজন বুঝে নেয়। আর যখন অন্যদেরকে পরিমাপ করে দেয় তখন
তাতে কম দেয়। তারা কি জানে না যে, একদিন তাদেরকে কিয়ামতে উঠানো
হবে? এক মহান দিবসের জন্য? যেদিন মানুষ
বিশ্ববাসীর রবের সামনে ঠায় দাঁিড়য়ে থাকবে।” এমনিভাবে
সূরা আনআমের ১৫২ নং আয়াত এবং সূরা ইসরার ৩৫ নং আয়াতসহ বিভিন্ন আয়াতেও তিনি ওজনে এবং
পরিমাপে ভেজাল করা থেকে সতর্ক থাকার জোর হুকুম দিয়েছেন।
এই ব্যাপারটি থেকে সতর্ক করার জন্য
আল্লাহ পাক নবী হিসেবে পাঠিয়েছিলেন হযরত শুয়াইব আ.কে তার ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কাছে।
কিন্তু আল্লাহ পাকের নির্দেশ মতো ঈমান না আনায় এবং এ অসৎ কাজ থেকে ফিরে না আসায় আল্লাহ
পাক তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের সূরা হুদের ৮৫ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে
নবীর সেই আর্তি- ‘হে আমার জাতি, তোমরা ঠিকমতো ওজন দাও এবং পরিমাপ করো, মানুষকে তাদের
দ্রব্যে ঠকিয়ো না, তোমরা এ পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বেড়াবে
না।’ সূরা শুয়ারার ১৮১ থেকে ১৮৩ নং আয়াতেও এভাবে বর্ণিত
হয়েছে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া সে জাতির পরিণতির কথা মনে করিয়ে দিয়ে আল্লাহ পাক সতর্ক করছেন
আমাদেরকেও।
সাধারণ ব্যবসায়ীদের ধারণা, আল্লাহ পাক তো ‘ইবাদতে’র হুকুম করেছেন। আমরা তো তা করছিই। নামাজ পড়ছি, দান খয়রাত করছি। এই হাট বাজারে কেনা বেচায় আবার ‘কুরআন হাদীস’ কীসের?
এগুলো তো আমাদের অভিজ্ঞতা ও বাজারের চাহিদার উপর নির্ভরশীল।
ব্যাপারটি যদি এমনই হতো, তবে আল্লাহর রাসূল মসজিদ ছেড়ে বাজারে যাচ্ছেন কেন? তিনি এক লোকের দোকানে গিয়ে খাবারের স্তুপের (গমের) ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলেন।
দেখলেন, এর ভেতরের অংশগুলো ভেজা। তিনি তাকে বললেন, এসব কী করছো তুমি? লোকটি জানালো, বৃষ্টির পানি পড়েছিল, তাই ভেজাগুলো নীচের দিকে (আড়াল
করে) রেখেছি। তুমি কেন সেগুলো উপরের দিকে রাখছো না যাতে মানুষ এর পুরো অংশটুকু দেখতে
পারে। মনে রেখো, যে অন্যকে ধোঁকা দেয়, সে
আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। (আবু হুরাইরা রা. থেকে মুসলিম শরীফের বর্ণনা)
মালিকের অজান্তে কিছু নিয়ে যাওয়ার
নাম চুরি। তার সামনে জ্ঞাতসারে জোর করে নেওয়ার নাম ডাকাতি। কিন্তু এ ঠগবাজির মহোৎসবে
তো ডাকাতির সাথে যোগ হচ্ছে প্রতারণাও। একবার ভাবুন তো, এভাবে সামান্য কম দিয়ে কতগুলো অসামান্য কবিরা গোনাহর ভয়ংকর শাস্তি
নিজের কাঁধে নিয়ে নিচ্ছি আমরা? মাত্র কয়েক সেকেন্ড সামান্য মোমবাতির
আগুন সহ্য করার ক্ষমতা নেই যে মানুষের, তারাই আজক্ষনস্থায়ী সময়ের
সামান্য কিছুর বিনিময়ে কিনে নিচ্ছি অনন্ত জীবনের তীব্র যন্ত্রনাদায়ক কঠিন শাস্তির নিশ্চয়তা।
ইবনে মাজাহ এবং বায়হাকী শরীফে হযরত
আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল সা. বলেছেন, পাচঁটি বিষয় এমন ভয়াবহ যে তোমরা সেগুলোতে লিপ্ত হলে এর পরিণতি
তোমাদের উপর নেমে আসবে দুনিয়াতেই। এর মধ্যে তিনি বলেছেন, তোমরা
যদি ওজনে কম দাও কিংবা পরিমাপে মানুষকে ঠকাও তখন অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষ নেমে আসবে।
খাদ্য সামগ্রী ও রসদের অভাব দেখা দিবে। তোমাদের শাসকরা তখন অত্যাচারী হয়ে যাবে।’
প্রিয় পাঠক, চিরসত্যবাদী ও দয়ালু প্রিয়নবী সা. এর এ সতর্কবাণী কি আমাদের দেশ
ও পরিবেশের বর্তমান সংকট ও দূর্দশার কারণ বলে দিচ্ছে না? আমাদের
সমগ্র সত্ত্বা নিবেদিত হোক প্রিয়নবীর কদমতলে, আজ থেকে চৌদ্দশ
বছর আগে তিনি যে পাপ ও পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, আমরা সেসবে লিপ্ত হয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি এর যন্ত্রনা। ঘাটে ঘাটে শোধ করছি
এ দূর্বিষহ জীবনের কড়া মাশুল।
নিজের বেলায় ষোল আনা, অন্যের বেলায় দুই আনা- এমন লোভ ও হঠকারিতা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে
আসতেই হবে। মনে রাখতে হবে, নামাজ রোযায় ত্র“টি হলে আল্লাহ পাক হয়তো তা নিজের দয়ায় মাফ করে দিতে পারেন, কিন্তু মানুষকে সামান্য অণু পরিমাণ ঠকানো হলেও এর দায়ভার আল্লাহ
পাক মাফ করবেন না, যতক্ষণ না প্রতারিত ক্রেতা মাফ না করে দিবে।
এজন্যই কিয়ামতের মাঠে প্রতারিত ক্রেতাকে
ডেকে আল্লাহ পাক ঐ প্রতারকের আমলনামা থেকে সমপরিমাণ সওয়াব তাকে দিয়ে দিবেন, প্রতারকের আমলনামায় যদি সওয়াব-ই না থাকে তবে প্রতারিতদের গোনাহ
তার কাঁধে চাপিয়ে দিবেন। সেদিন কাঁদতে কাঁদতে যদি শরীরের প্রতিটি লোমকূপ থেকে রক্তও
বেরিয়ে যায়, তাতেও কোন কাজ হবে না।
এ তো গেল পরকালের আমলনামার কথা। কিন্তু
এর আগেই তো এমন প্রতারক বহি®কৃত হয়ে যায় নবীর ‘উম্মত হওয়া’ থেকে।
কারণ রাসূল সা. বলেছেন, যে অন্যকে ধোঁকা দিল সে আমার উম্মত নয়।
বুখরী ও মুসলিমের বর্ণনায় হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা.
বলেছেন, নিজের জন্য যা ভালোবাসো তা অন্যের জন্যও পছন্দ করার আগ
পর্যন্ত কেউ ঈমানদার হতে পারে না। তাই সময় থাকতেই ছেড়ে দিতে হবে সব প্রতারণা,
ধোঁকাবাজি ও অন্যকে ঠকানোর সব ধান্দা ফিকির। ওজন ও পরিমাপে হতে হবে সৎ
ও সচেতন। প্রতিজ্ঞা হোক, মানুষের অধিকার ও হক নিয়ে কোন অবহেলা
আজ থেকে আর নয়।
দিনের শুরুতে অনেক ব্যবসায়ী নিজেদের
দোকান খুলে ‘সূরা আর রাহমানের’ তিলাওয়াত শুনে কেনাবেচা শুরু করেন। আহা! শুধু শুনেই গেলাম,
কখনো কি অন্তত এ সূরাটির অর্থ নিয়ে ভেবেছি? সূরাটির
সূচনায় ৯ নং আয়াতে আল্লাহ পাকের নির্দেশ ‘তোমরা ঠিকমতো ওজন করো এবং পরিমাপে কম দিয়ো না’ আমাদের
ভেতরে কি কোন তাগিদ দিচ্ছে না? নিছক ক্যাসেট থেকে ভেসে আসা তেলাওয়াতের
সুললিত কন্ঠ নয়, কুরআনের ছোঁয়ায় সুরভিত হোক আমাদের আত্মার অর্ন্তজগত।
সেটিই তো কুরআনের দাবী, পরম সাফল্যের প্রধান চাবিকাঠি।